স্থানীয় খবর

শিকড়ের সন্ধানে মুনসী পরিবারের গোড়াপত্তন

Spread the love


মুনসী সাইফুল বারী ডাবলু
{মুনসী পরিবারের গোড়াপত্তন কিভাবে কখন হয়েছিল তা আমার জানার আগ্রহ অনেক আগে থেকেই। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে পুর্বপুরুষদের সম্পর্কে বেশী কিছু জানতে না পারলেও আমার একমাত্র চাচা ও ফুফুর নিকট থেকে কিছু তথ্য পেয়ে জানার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। মুনসী পরিবারের শিকড়ের সন্ধান করতে গিয়ে সিরাজগঞ্জ থেকে প্রকাশিত এসএম আব্দুস সামাদ রচিত “গৌরবাম্বিত সদানন্দপুর”গ্রন্থ, খন্দকার আব্দুর রহিম রচিত “সিরাজগঞ্জের ইতিহাস” গ্রন্থ ও কড্ডা গ্রামের মরহুম মুনসী মফিজুল হক সিদ্দিকীর পান্ডুলিপি থেকে মুনসী পরিবার সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি এবং সদানন্দপুর ও কড্ডা গ্রামের প্রবীন লোকজনের সাথে কথা বলে যে তথ্য পেয়েছি তা এই লেখার মাধ্যমে পাঠকদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ}।
বাঙালির বংশ পদবীর ইতিহাস খুব বেশি প্রাচীন নয়। মধ্যযুগে সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার ফলে পরবর্তীতে বৃটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমান্তরালে বাঙালির পদবীর বিকাশ ঘটেছে বলে মনে হয়। অধিকাংশ ব্যক্তির নামের শেষে একটি পদবী নামক পুচ্ছ যুক্ত হয়ে আছে। যেমন উপাধি, উপনাম কিংবা বংশসূচক নামকে সাধারণ ভাবে পদবী বলা হয়। বাঙালির মূল নামের শেষে বংশ ,পরিবার, পেশা, বসতিস্থান ইত্যাদির পরিচয়বাহী উপনাম ব্যবহারের রীতি প্রচলিত রয়েছে। সামন্ততান্ত্রিক পদবীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ক্ষেত্রেই জমি ও হিসাব সংক্রান্ত পদবী। তবে এই সমস্ত পদবীর বেশির ভাগই বংশ পরস্পরায় চলে আসলেও বর্তমানে পদবীর সমাজ গত মূল্য নেই বললেই চলে। ইতিহাসের দিন বিচার করলে দেখা যাবে পদবী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাঙালি মুসলমানের পরিচয় ও মর্যাদাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ড. মোহাম্মদ হাননান এর ভাষায় ‘বাঙালি হিন্দু সমাজের বহুল কথিত ছত্রিশ জাতের মতো মুসলমান সমাজের সাধারণভাবে বর্ণভেদের সামাজিক, রাষ্ট্রিক, এমনকি অর্থনৈতিক মূল্য নেই বটে, (কতকক্ষেত্রে ধর্মগত মূল্য রয়েছে। তবে সেটা পীর এবং মুরীদানের ক্ষেত্রে মাত্র), তথাপি বাঙালি মুসলমান সমাজের বিকাশের প্রাথমিক দিনগুলিতে এই পদবী চেতনা জাত-ভেদ ও সামাজিক মূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করতো। সুতরাং পদবী মাহাত্ম্য ও তার তাৎপর্যের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে জাত ও শ্রেণী চেতনা। বাঙালি মুসলমান সমাজের একটা বড় সময় পার হয়েছে এই মনস্তাত্তিক দ্বন্দ্বে, যে দ্বন্দ্বে অঙ্গার হয়েছে বাঙালি হিন্দু সমাজ। তবে হিন্দু সমাজের মতো মুসলমান সমাজের মনস্তত্বে পদবীর কৌলীন্য বড় একটা প্রসার লাভ করতে পারেনি ইসলামের মৌলিক আদর্শের কারণেই, যেখানে রক্ত ও বর্ণে সকল মানুষকে সমান মর্যাদা দান করা হয়েছে। শিশু কাল থেকেই একজন বাঙালি পদবীর স্পর্শে আপন জনের সমাদর লাভ করে বলে পদবী চেতনা সকলের মনে প্রাচীন একটা সংস্কারগত রীতির আভাস দেয়। মনে হয় যুগযুগ তার বংশ গৌরব বা অগৌরব সবকিছুই বংশ পরম্পরায় এসেছে তার নিজের সময় পর্যন্ত।
অষ্টম শতকে বাংলাদেশে চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার পর গ্রাম সভা ও বিশিষ্ট নাগরিকরা সাধারণ একজনকে সম্রাট পদে বসিয়ে দিয়ে ছিলেন, যার নাম ‘গোপাল’। কিন্তু এই গোপালের নামের শেষাংশ ধরে রাখবার প্রচেষ্টায় উত্তরাধিকাররা ক্রমান্ননে সকলেই নামের শেষে গোপাল এর ‘পাল’ অংশকে পদবী হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন, পরে তাই ঐতিহাসিক পাল বংশের সূত্রপাত ঘটায়। আবার বল্লাল সেনের আমলে ছত্রিশটি জাত সৃষ্টি করে ছত্রিশটি আলাদা মর্যাদা তৈরি করা হয়েছিল। সমাজে এভাবে ছত্রিশটি প্রধান পদবীরও সৃষ্টি হয় পেশা গুনে গুণে। এর পর ৩৬ টি জাতে আরো শত রকম বিভাজন ঘটে এবং শত শত পদবীর সৃষ্টি হয় বাংলার সমাজে। এই সব শত শত পদবীর উত্তরাধিকারত্ব লাভ করেছে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল বাঙালি বৌদ্ধ, বাঙালি হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমান। তাই তো দেখি চৌধুরী, তালুকদার, বিশ্বাস, মজুমদার, মুন্সী, সরকার, সরদার প্রভৃতি প্রায় সকল পেশাগত সামাজিক পদবী রয়েছে হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ স¤প্রদায়ে প্রায় সমানভাবে।
বাঙালি হিন্দু বা মুসলমান কিংবা খ্রিস্টান অথবা বৌদ্ধ সমাজে পদবী এসেছে বিচিত্রভাবে। ব্যক্তি বিশেষের নাম থেকে যেমন বংশ পদবীর ব্যবহার হয়েছে, তেমনি পদবী এসেছে বিভিন্ন পেশা থেকেও। শিক্ষক, সৈনিক, কারুশিল্পী, বণিক, রাজকর্মচারী, রাষ্টীয় উপাধি, গ্রাম অঞ্চল বাসী ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে সামাজিক পদবীর সৃষ্টি হয়েছে এবং নির্বিচারে তার ব্যবহারও হয়েছে। প্রাচীন যুগে অর্থাৎ হিন্দু আমলে এবং মধ্যযুগের মোঘল-পাঠান শাসনামলে ও আধুনিক কালের শাসনামলে পদবী সমূহ কম-বেশি সংস্কারকৃত হয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজে প্রচলিত হয়েছে। তবে কিছু পদবী আছে, যা বাঙালি সমাজে শুধু হিন্দুশ্রয়ী, কিছূ পদবী একান্তই মুসলমানী, আবার বেশ কিছু পদবী হিন্দু – মুসলমান নির্বিশেষে সকল স¤প্রদায়েই নির্বিচারে ব্যবহৃত হয়। শেখ, সৈয়দ, চৌধুরী প্রভৃতি বংশ পদবী বাঙালি মুসলমান সমাজকে আশরাফ এবং আতরাফ এইদুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেছিল। একদা এই তথাকথিত আশরাফ স¤প্রদায় বাঙালি মুসলমান সমাজে শ্রেণী বৈষম্য সৃষ্টি করেছিলেন। এদেশের সাধারণ মুসলমানকে বলা হতো আতরাফ যার আভিধানিক অর্থ নিচু সমাজ, নিচু বংশ- নিচু বর্গের লোক। একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, একমাত্র পদবী চেতনাই বাঙালি মুসলমান সমাজে সীমিত অর্থে হলেও একটা সময় সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য সৃষ্টি করে রেখেছিল। সেদিক থেকে বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাসের একটি দীর্ঘ কাল পূর্বে থেকে পদবীই নির্ধারণ করে বাঙালি মুসলমানের সামাজিক মর্যাদা। আর মজার ব্যাপার হলো অন্তত পদবীর পরিচিতিতে বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দু জাতি গত ঐতিহ্যের শিকড়কে খুঁজে পাওয়া যায়। ধর্মগত বিভাগের খোলসের বাইরে বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের বংশগত ও পেশাগত ঐতিহ্যের গোড়ার কথা সন্ধান মেলে এই পদবী পরিচিতিতে। শেখ, সৈয়দ,মোগল, পাঠান, কাজী, গাজী, শাহ, মুনসী, মিঞা, মীর্জা, মোল্লা, খন্দকার ইত্যাদি কয়েকটি ভিনদেশী পদবী যা উপ মহাদেশে মুসলমান আগমনের সাথে জড়িত সে কয়টি পদবী বাদে বাংলার অধিকাংশ পদবীই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রায় সকল ধর্মে ও বর্নে সুলভ।
বাঙালির বংশ পদবীর বেশীর ভাগই এসেছে পেশা ও উপাধী থেকে, বাঙালির সমাজ বিন্যাসেও বংশ পদবীর রয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষ এক অসাধারণ চরিত্র। জমিদার শ্রেণীর উত্থান ঘটেছিল হিন্দু-মুসলমান উভয় স¤প্রদায়ের নব্য ধনীদের থেকেই। সুতরাং জমিদারের প্রতীক পদবী ‘চৌধুরী’ পরিচয় পাওয়া যায় বাংলার উভয় স¤প্রদায়েই। এমনকি বৌদ্ধ স¤প্রদায়েও চৌধুরী, পদবীর ব্যবহার রযেছে। বাঙালির জমি- জমা বিষয় সংক্রান্ত আরো কিছু পদবী যেমন- হালদার, মজুমদার, তালুকদার, পোদ্দার, সরদার, প্রামাণিক, হাজরা, হাজারী, মন্ডল, মোড়ল, মল্লিক, সরকার, বিশ্বাস ইত্যাদি বংশ পদবীর রয়েছে হিন্দু -মুসলমান নির্বিশেষে সকল স¤প্রদায়েই একান্ত রূপ। দুই স¤প্রদায়েই এই একই পদবীর ব্যবহার অত্যন্ত তাৎপর্য পূর্ন। বাঙালির সামাজিক ইতিহাসে এর ভূমিকা অসাধারণ ও প্রগতিবাহী, ‘ভূইয়া’ ও হিন্দু সমাজে ‘ভৌমিক’ নামে পরিচিত হয়েছে। খান বংশ পদবী, যার আগমণ কিনা সুদূর আফগান পাঠান মূলুক থেকে, তা একান্তভাবে মুসলমানদের বংশ পদবী হলেও অনেক সমাজেও ‘খান’ পদবী একেবারে দূলর্ভ নয়। ঠাকুর বংশ পদবী একান্তভাবে হিন্দুর পদবী বলে মনে হলেও প্রচুর বনেদী মুসলমানের রয়েছে ঠাকুর পদবী। বাঙালি হিন্দুর রয়েছে আলাদা ও স্বতন্ত্র পদবী যা একান্তভাবে তাদের অনেকটা গোত্রভূক্ত, বংশগত এবং কৌলিন্যের ও জাতিগত স্পর্শতা যুক্ত বলা চলে। বাঙ্গালির বর্ণ হিন্দু ব্রাক্ষণের জনপ্রিয় বংশ পদবী হচ্ছে বন্দ্যোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায় ইত্যাদি। এ গুলো কতকগুলি গ্রাম গোত্রের নাম থেকে উদ্ভুত। ‘পাল পদবীকে ইতিহাসের দিক থেকে হিন্দু পদবীর বলা যায় না। কারণ প্রাচীন ইতিহাসের বৌদ্ধ পাল বংশের রাজাদের থেকে পাল বংশ পদবীর বিকাশ। এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদগণ একমত হবেন যে, পাল রাজা গোপাল, রামপাল প্রমুখ থেকে পাল পদবী, পরে জাতিগত পদবী হিসেবে বিকশিত। তবে কুমার স¤প্রদায়ের লোকেরাও পাল পদবী ব্যবহার করে।
বাঙালি মুসলমানের শিক্ষক পেশার পদবী হলো-খন্দকার, আকন্দ, নিয়াজী ইত্যাদি। আর বাঙালি হিন্দুর শিক্ষক পদবী হচ্ছে দ্বিবেদী, ত্রিবেদী, চর্তুবেদী ইত্যাদি। মুসলমানদের ‘লোহানী’ পদবীর মতো হিন্দু সমাজের রয়েছে সাহানী পদবী। মনে করা হয় এই বংশ পদবী এসেছে সিন্ধু প্রদেশের সাহান অঞ্চল থেকে। বাঙালি মুসলমানের যেমন প্রয়োজনের অতিরিক্ত আরবী-ইরানী প্রীতি রয়েছে, বাঙালি খ্রিস্টানেরও তেমনি রয়েছে ইংরেজ, পর্তুগীজ তথা পাশ্চাত্য প্রীতি। পৃথিবীর যে কোন ভূখন্ডের ভাষা ও জাতীয়তায় মুসলমান হতে ধর্মগত বাধা না থাকলেও বাঙালি মুসলমানরা যেমন-আরবী-ফার্সীর প্রতি অতিরিক্ত প্রীতি দেখিয়ে থাকে, তেমনি বাঙালি খ্রিস্টানও দেখিয়ে থাকে পাশ্চাত্য প্রীতি। যেমন-বাঙালির মহাকবি মধুসূদন দত্ত হিন্দুত্ব ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়ে উনিশ শতকে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু এই মহান বাঙালিও বাঙালি চরিত্রের এতোটুকু স্খলন না ঘটিয়ে পিতৃ নামের আগে মাইকেল যোগ করেছিলেন। দত্ত পদবী ত্যাগ করেননি তিনি। বাঙালি খ্রিস্টানের ইতিহাস চার শত বছরের প্রাচীন। বিদেশী খ্রিস্টান পুরোহিত বাংলা দেশে তাঁদের ধর্ম যাত্রা উপলক্ষে বাঙালিদেরকে খ্রিস্টান ভূক্ত করতে থাকেন। তাদের নাম অথবা সেই পুরোহিত যে অঞ্চল থেকে আগত সেই অঞ্চলের নামানুসারে খ্রিস্টান ধর্মের নতুন ভাবে দীক্ষিত বাঙালি পদবীর সমাবেশ ঘটাতে থাকেন। বাঙালি খ্রিস্টানের পদবীর মাহত্ম্য ও তাৎপর্য থেকে অনুধাবন করা যায়, যে সব পর্তুগীজ খ্রিস্টান ধর্মযাজক এদেশে এসেছিলেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন পর্তুগালের বিভিন্ন দ্বীপের অধিবাসী। সম্ভবত কোন ধর্মযাজক কতজন বাঙালিকে ধর্মান্তরিত করেছেন তা চিহ্নিত করার জন্যেই দেশান্তরিত নতুন বাঙালি খ্রিস্টানের নামের সাথে এই অঞ্চলের নাম বিশিষ্ট পদবী যুক্ত করা হতো। বাঙালি খ্রিস্টানের ‘ডি কষ্টা’ পদবী বলতে পর্তুগীজ ধর্মযাজক দ্বারা ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান বুঝতে হবে। ‘ডি রোজারিও’ পদবী মানে রোজারিও নামের দ্বীপ থেকে আগত ধর্ম যাজক দ্বারা খ্রিস্ট ধর্মে আলোকিত। ‘ডি’মানে এখানে ‘দ্বীপ’ বোঝানো হয়। গমেজ আর একটি বাঙালি খ্রিস্টানের বংশ পদবী। বাঙালির বংশ পদবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় উপরোক্তদের ছাড়াও কিছু ক্ষুদ্র জাতি সমূহের কিছু পদবী রয়েছে। যেমন-চাকমা, দেওয়ান, রায় ইত্যাদি। উপজাতি চাকমা ক্ষুদ্র জাতির প্রধান পদবী হচ্ছে ‘চাকমা’। এছাড়া ‘খীশা’ পদবীর ব্যবহারও দেখতে পাই। বাঙালি গারো, সাওতাল, হাজং প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি গুলি মধ্যে প্রচলিত রয়েছে বিচিত্র রকমের বংশ পদবী।
বাঙালির কিছু বিখ্যাত বংশ পদবীর ইতিহাস তুলে ধরতে চাই। এই যেমন-শিকদার, সৈয়দ, শেখ, মীর, মুনসী, মোল্লা, মিঞা, আকন্দ, চৌধুরী, ভুইয়া, মজুমদার, তরফদার, তালুকদার, সরকার, মল্লিক, মন্ডল ইত্যাদি।
শিকদারঃ সুলতানি আমলে কয়েকটি মহাল নিয়ে গঠিত ছিল এক একটি শিক। আরবি শিক হলো একটি খন্ড এলাকা বা বিভাগ। এর সাথে ফারসি দার যুক্ত হয়ে শিকদার বা সিকদার শব্দের উদ্ভব হয়েছে। এরা ছিলেন রাজস্ব আদায়কারী রাজকর্মচারী। শব্দকোষে যাকে বলা হয়েছে শান্তিরক্ষক কর্মচারী। এরা শিক বন্দুক বা ছড়ি বন্দুক ব্যবহার করতো বলে শিকদার উপাধী পেয়েছিল; সেই থেকে বংশ পরমপরায় শিকদার পদবীর বিকাশ ঘটে।
সৈয়দঃ সৈয়দ পদবী মূলত এসেছে নবী নন্দিনী হযরত ফাতেমা ও হযরত আলীর বংশ ধর থেকে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের এই বংশের সাথে কোন যোগসূত্র না থাকলেও বাংলাদেশের অনেক মুসলমান পরিবার সৈয়দ বংশ পদবী ব্যবহার করে নিজেদের সম্ভ্রান্ত ও কুলীন মুসলমান বলে দাবি করে থাকেন। বাঙালি মুসলমান সমাজে সৈয়দ পদবীর অপব্যবহার ও পক্ষেপণ ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। প্রকৃত পক্ষে সৈয়দ নন এবং পারিবারিক কোন কুলীন পদবীও নেই, অথবা পূর্ব পদবী ঐতিহ্য পরিত্যাগ করতে ইচ্ছুক এমন অনেক বংশ গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বিশেষে বাংলাদেশে সৈয়দ পদবী ব্যবহার করে।
শেখঃ শেখ আরবি থেকে আগত পদবী। সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের সম্মানসূচক বংশ পদবী শেখ। যিনি সম্মানিত বৃদ্ধ অথবা যিনি গোত্র প্রধান, তাকেই বলা হতো শেখ। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) সরাসরি যাকে বা যাঁদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন, তিনি বা তার বংশ ধরও শেখ নামে অভিষিক্ত হতেন অথবা শেখ পদবী লাভ করতেন। বাঙালি সৈয়দ পদবী ধারীদের থেকে শেখ পদবীধারীদের এখানে একটা মৌলিক তাৎপর্যগত পার্থক্য রয়েছে। শেখ পদবী গ্রহণের নেপথ্যে রয়েছে ঐ পূর্বোক্ত চেতনা। নবীর হাতে মুসলমান না হলেও বাংলায় ইসলাম ধর্ম আর্বিভাবের সাথে সাথে যারা নতুন ধর্মকে গ্রহণ করে নেন ‘নও মুসলমান’ হিসেবে প্রাচীন ও মধ্যযুগে তারাই শেখ পদবী ধারণ করে ছিলেন। পরবর্তীকালে তাদের বংশের উত্তর সূরীরাই শেখ পদবী ব্যবহার করে এসেছেন।
মিঞাঃ মিঞা মুসলিম সামাজিক ব্যক্তিকে সম্বোধন করার জন্য ব্যবহৃত সম্ভ্রম সূচক শব্দ। এক অর্থে সকল মুসলমানের পদবীই হচ্ছে মিঞা। বাঙালি হিন্দুর ‘বাবু’ অথবা ‘মহাশয়’ এর পরিবর্তে বাঙালি মুসলমান ‘মিঞা’ শব্দ ব্যবহার করে থাকে। এখন অনেক অশিক্ষিত অল্পশিক্ষিত মুসলমানই ‘মিঞা’ পদবী বেশী ব্যবহার করে। ‘মিঞা’ শব্দটি এসেছে ফারসি ভাষা থেকে।
মোল্লাঃ মোল্লা একটি জনপ্রিয় পদবী। তাদের প্রসার প্রায় দেশব্যাপী। বঙ্গীয় শব্দকোষ এ মোল্লা শব্দের অর্থ করা হয়েছে মুসলমান পুরোহিত। বস্তুত এভাবে মসজিদে নামাজ পরিচালনার কারণেও অনেকে মোল্লা উপাধি পেয়েছিল এবং তার পর থেকেই মোল্লা পদবীর ব্যবহার শুরু হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে, মোল্লা হচ্ছে তুর্কি ও আরবি ভাষা থেকে আগত একটি শব্দ যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে পরিপূর্ণ জ্ঞান বিশিষ্ট মহাপন্ডিত ব্যক্তি। অন্য অর্থে মুসলিম পন্ডিত বা ব্যবস্থাপক বা অধ্যাপক হলেন মোল্লা। পরবর্তী কালে মসজিদে নামাজ পরিচারলনাকারী মাত্রই মোল্লা নামে অভিহিত হতে থাকে। এখান থেকেই সাধারণত বংশ পদবী হিসেবে তা ব্যবহার হওয়া শুরু হয়।
আখন্দঃ খন্দকার ও আখন্দ বা আকন সমার্থক। আখন্দ ও আকন নামে যে সব পদবী তাও সম্ভবত খন্দকার পদবীরই রূপভেদ। খন্দকার>আখন্দ> আকন হয়ে থাকতে পারে। আবার ফারসি আখুন্দ থেকেও আখন্দ এসে থাকতে পারে। যার অর্থ শিক্ষক। তবে আকন্দ এসেছে আখন্দ থেকেই।
চৌধুরীঃ সংস্কৃত চতুধারী শব্দ থেকে এসেছে বাংলা চৌধুরী শব্দ। এর অর্থ চর্তুসীমানার অন্তগর্ত অঞ্চলের শাসক। বাংলাদেশের বেশির ভাগ জমিদারদের পদবী হচ্ছে চৌধুরী। আবার অনেকে মনে করেন ‘চৌথহারী’ যার অর্থ এক চতুথাংশ রাজস্ব আদায়কারী, সেখান থেকে উচ্চারণ পরিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে ‘চৌধুরী’। সেদিক থেকে চৌথ আদায়কারী বা রাজস্ব আদায়কারী পদ সৃষ্টি হয়েছিল বাংলার রাষ্ট্র ব্যবস্থার। বঙ্গীয় শব্দকোষ বলছে,‘চতুর’ যার অর্থ তাকিয়া বা মসনদ, তার সাথে যুক্ত হয়েছে ‘ধর’ (অর্থ ধারক) এবং এই দুয়ে মিলে হয়েছে ‘চৌধরী’ > আর তার থেকেই ‘চৌধুরী’। ভূঁইয়াঃ এই বংশ পদবীটি এসেছে খোদ ভূমির মালিকানা অর্থ থেকে। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় স¤প্রদায়ের মধ্যে এ পদবীর প্রচলন আছে। বাঙালি হিন্দু সমাজে যাঁরাই ‘ভৌমিক’ বাঙালি মুসলমান সমাজে তারা ‘ভূঁইয়া’ হিসেবে পদবী ধারণ করেছেন। প্রাচীন বড় জমিদার বা সামন্ত রাজার উপাধিও ছিল ভূঁইয়া। প্রকৃত পক্ষে কুলীন বংশ পদবীই ছিল তা।
মজুমদারঃ ‘মজুমদার’ পদবী মূল আসলে ‘মজুনদার’। এর মূল ফারসি শব্দ হচ্ছে ‘মজমু আনদার’।রাষ্ট্রের ও জমিদারির দলিল পত্রাদির রক্ষক রাজকর্মচারীর জন্যে এই পদবী সংরক্ষিত ছিল। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমগ্র বাংলাদেশে ‘মজুমদার’ পদবীর ব্যবহার লক্ষনীয়।
তরফদারঃ আরবি ‘তরফ’ এবং ফারসি ‘দার’ মিলে তরফদার শব্দের সৃষ্টি। জমিদারের খাজনা আদায়ের মহালে তদারককারী কর্মচারী বা খাজনা আদায়কারীর উপাধী ছিল তরফদার। এই পদবী ব্যবহারকারী গোষ্ঠীর পূর্ব পুরুষরা এই কাজে নিযয়োজিত ছিলেন, সেখান থেকেই এই বংশ পদবী উৎপত্তি ও প্রচলন। অন্যমতে তরফদার তরফের রাজস্ব আদায়কারী লোক।
তালুকদারঃ আমাদের দেশে সুপরিচিত একটি বংশ পদবী। বাংলাদেশে জমিদারির পরই তালুক ভূ-সম্পত্তির একটি বিভাগ। মোগল ও বৃটিশ আমলে রাজস্ব ও ভুমি সংক্রান্ত বিষয়াদি থেকে যে সমস্ত পদবীর উৎপত্তি ও বিস্তার তার মধ্যে ‘তালুকদার’ হচ্ছে সবচেয়ে সম্মানীয় পদবী। ‘তালুক’ শব্দ থেকেও এই পদবীর মর্মাথ উপলব্ধি করা সম্ভব। আরবি শব্দ ‘তা’ আলুক’ যার অর্থ ভূ-সম্পত্তি এবং এর সাথে ফারসি ‘দার’ যুক্ত হয়ে (তা’আলুক+দার) ‘তালুকদার’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। যিনি জমিদার তিনিই হচ্ছে তালুকদার। তবে মনে হয় ‘ক্ষুদ্র জমিদার’ তা না হলে ‘জমিদার’ শব্দ থাকার পরও ‘তালুকদার’ শব্দের উৎপত্তি বা প্রচলন হতো না। প্রকৃত পক্ষে, যিনি তালুকদার, তিনি জমি ও ক্ষুদ্র ভূ-সম্পত্তি বন্দোবস্ত নিতেন সরকারের কাছ থেকেও যেমন, তেমনি জমিদারের কাছে থেকেও। ফলে তিনি হতেন উপজমিদার সেই অর্থেই এসেছে ‘তালুকদার’। বাঙালির ‘জমিদার’ শব্দ দিয়ে কোনো পদবী নেই, অথচ ছোট জমিদার ‘তালুকদার’ শব্দের পদবী রয়েছে।
সরকারঃ ‘সরকার’ শব্দটি ফারসি থেকে আগত। এর অর্থ প্রভূ, মালিক, ভূস্বামী, শাসনকর্তা, রাজা। অর্থ আদায় ও ব্যয় সংক্রান্ত কর্মচারি ও সরকার। মোগল আমলে এদেশের স্থানীয় রাজকর্মচারিদের এ পদবী দেয়া হতো। মোট কথা প্রধান কর্মচারি এবং সম্পত্তি দেখাশুনার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে সরকার বলা হতো। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম উভয় স¤প্রদায়ের মধ্যেই এ পদবীর ব্যবহার আছে।
এরকম শতাধিক বংশ পদবী রয়েছে আমাদের দেশে। সব বংশ পদবীর ইতিহাস লিখলে বিশাল আকৃতির বই হবে। আমি আর সে দিকে যেতে চাইনা। পরিশেষে বলতে চাই বাঙালির পদবীর ইতিহাস বৈচিত্র পথ ও মতের এক অসাধারণ স্মারক হিসেবে চিহিৃত। বাঙালি মুসলমানের পদবী ব্যবহারের উদ্যোগ খুব বেশি প্রাচীন না হলেও, তাতে কম করে হলেও হাজার বছরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বাঙালির বংশ পদবী গুলোর মধ্যে রয়েছে কিছু আঞ্চলিক পদবী, শুধু অঞ্চল থেকেই তার জন্ম ও ব্যবহার। কিছু পদবী রয়েছে একেবারে বাঙালির জাতীয়। সারা বঙ্গ জুড়েই তার প্রসার। কয়েকটি অবশ্য ধর্মীয় পদবী রয়েছে, যা হিন্দু-মুসলমানদের একান্ত নিজস্ব। তবে জনপ্রিয় পদবী গুলির বেশির ভাগই ধর্ম নিরপেক্ষ এবং একান্তভাবে বাঙালির সম্পদ।
“মুনসী পদবী এলো কিভাবে”
শব্দটি অনেক রকম লেখার চল আছে। মুনশী, মুনশি, মুনসি, মুনসী, মুন্সি বা মুন্সী। যেভাবেই লেখা হোক শব্দটি আরবি। ব্যবহৃতও হয়েছে নানা অর্থে লিপিকর বা লেখক, ফারসি ভাষার শিক্ষক, কেরানি কিংবা গৃহশিক্ষক। বাংলা এমনই ভাষা সহজেই আপন করে নিতে পারে অন্য ভাষার শব্দকে। মুনসীর বেলায়ও সেটা হয়েছে।
আরব উপদ্বীপ থেকে এ শব্দটির নাইওর আসার দিনক্ষণ অজ্ঞাত হলেও কারণটি স্পষ্ট। বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয়। আরব বণিকরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যেই উপমহাদেশে আসেন। সেটা ষষ্ঠ শতকের কথা। সিংহলে ছিল তাঁদের ঘাঁটি। অনেক আরব বণিক স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থিতুও হয়েছিলেন সেখানে। সপ্তম শতকের প্রথম ভাগে আরবে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ঘটে এক মহাজাগরণ। তার ঢেউ এসে লাগে ভারত সাগরের উপকূলেও। অষ্টম শতকে সিন্ধু বিজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতে শুরু হয় ইসলামের রাজনৈতিক যাত্রা। বাংলায় তখন পালদের শাসনামলের শুরুর সময়। মুসলমানদের রাজনৈতিক বিজয় অব্যাহত থাকে পরের এক হাজার বছর। সেই অবসরে বাংলা ভাষাও পেয়ে যায় শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণের মওকা। মাঝে শুধু সেন আমলে (১৩ শতকের শুরুর দিক) একটা বড়সড় ধাক্কা খেয়েছিল।
মুসলিম শাসকদের ভাষা ছিল আরবি মিশ্রিত পারসি বা ফারসি। দরবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশীয় অমাত্য আর কর্মচারীরাও দক্ষ হয়ে ওঠে রাজভাষায়। প্রভাব পড়ে জনগণের ওপরও। রাজ্য চালানোর প্রয়োজনেই রাজারাও চাইতেন এখানকার জীবনযাপন পদ্ধতি আর সংস্কৃতির সঙ্গে মিলমিশ রেখে চলতে। মোগলরাও এটা বজায় রেখে চলছিল। তারপর ভাস্কো দা গামার পথ ধরে নামল ইউরোপিয়ানদের ঢল। গড়ে উঠল ইউরোপীয় আদলের স্কুল-কলেজ। দরকার পড়ল পাঠ্য পুস্তক, সংবাদপত্র আর আইন-আদালতের জন্য দরকারি গ্রন্থ। প্রতিষ্ঠিত হলো ছাপাখানা। এরই সুবাদে তালপাতার ওপর নলখাগড়ায় লেখা পুঁথিপত্রের বদলে বাংলা ভাষা স্থান পেল ছাপা বইয়ে। আর এই বইগুলো হয়ে উঠল শব্দের ভান্ডার।
মধ্য যুগের শেষ কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর। লিপিকর বা লেখক অর্থে মুনশির প্রাচীনতম ব্যবহার দেখা যায় তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যের দ্বিতীয় খন্ড ‘বিদ্যাসুন্দর’ উপাখ্যানে। ভারতচন্দ্র লিখেছেন, ‘মুনশী বখশি বৈদ্য কানগোই কাজি’ আর মুনসী বানানে মুনশি পাওয়া গেল ব্রিটিশ সিভিলিয়ান জোনাথান ডানকানের লেখায়, ‘মুনসী ও মহরির সব কচহরিতে ব্যবস্থাপকদের সাক্ষাৎ।’ ডানকান ১৭৭২ সালে ভারতে এসে আইন পেশা শুরু করেন। ১৭৮৪ সালে তাঁর ‘মপসল দেওয়ানী আদালত সকলের ও সদর দেওয়ানী আদালতের বিচার ও ইনসাফ চলন হওয়ার কারণ ধারা ও নিয়ম’ নামক আইনবিষয়ক অনুবাদ গ্রন্থটি হুগলি থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর মুনশি (মুনসী) শব্দের ব্যবহার দেখা যায় ১৮২১ সালে। ১৮২৫ সালে প্রকাশিত ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নববাবুবিলাস রচনায়ও পাওয়া যায় মুনশি (মুনসী) শব্দের ব্যবহার। উল্লেখ্য, লেখক বা কেরানি অর্থে এর ব্যবহার এখনো দেখা যায় থানাগুলোতে। থানায় যাঁরা এজাহার বা অভিযোগ লেখেন, তাঁদের মুনসী বলেই ডাকা হয়। ভাষা শিক্ষক অর্থে মুনশি (মুনসী) শব্দের প্রথম ব্যবহার পাওয়া যায় উইলিয়াম কেরি সাহেব ও মুনসীর সংলাপে। কেরি ছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান। বাংলা শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি কয়েকটি গ্রন্থ প্রণয়ন করে ছিলেন। তার একটি গ্রন্থে রয়েছে সংলাপটি। সংলাপে মুনসীর উক্তি‘সাহেব আমি মুনসী, আমি এ দেশীয় ভাষা শিক্ষা করাই।’ সংলাপ শেষে সাহেব এ মুনসীকে নিযুক্ত করেন দেশীয় ভাষা শেখার জন্য। উল্লেখ করার মতো বিষয়, প্রমথনাথ বিশী ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ নামের একটি বই লিখেছিলেন। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পস্বল্প বইয়ের মুনশি গল্পের মুনশিও ছিলেন ফারসি ভাষার শিক্ষক। ইংরেজ আমলে ইংরেজি রাজভাষা হওয়ার পর ফারসি ভাষা জানা দরবারি লোকেরা বেকার হয়ে যায়। তাদের কদর সীমাবদ্ধ থাকে মসজিদ আর খানকায়। ফারসি জানা লোকদের মোল্লা বলেও ডাকা হতে থাকে। কালে কালে মুনশি শব্দটি মোল্লার সহচর হয়ে ওঠে।
“মোল্লা আর মুনসীর ফারাক অনেক”
যাঁরা গ্রাম্য মসজিদে ইমামতি করতেন, বালা মসিবতে দোয়া-দরুদ ও মিলাদ পড়াতেন, তাঁদের মোল্লা নামে ডাকা হতো। আবার কেউ কেউ মনে করেন যাঁরা গ্রাম্য মসজিদে ইমামতি করেন, বালা মসিবতে দোয়া-দরুদ ও মিলাদ পড়ান,আমপাড়া পড়ান বা গ্রামে গ্রামে শিশু কিশোরদের আরবী শিক্ষা দেন তারই হচ্ছে মুনসী। আসলে তা নয়। আসলে যাঁরা আরবি-ফারসি ভাষা ও সাহিত্য জানতেন, প্রসঙ্গক্রমে দুই-চারটি ফারসি বয়াত আওড়াতে পারতেন, ভালো বক্তৃতা দিতে পারতেন, যারা ভাল সাহিত্য রচনা করতে পারতেন, যারা লেখক সাহিত্যিক সাংবাদিক ছিলেন, যাদের মধ্যে পান্ডিত্য ছিল, এমনকি যারা সকল ভাল কাজে পারদর্শী ছিলেন তাঁদের ডাকা হতো মুনসী। আবার কোন লোক যদি কোন কাজ সুষ্ঠ ও সুন্দরভাবে সম্পন্œ করতে পারে তাহলে লোকজনকে এমন কথাও বলতে শোনা যায় যে এই কাজের মধ্যে মুন্সীয়ানা রয়েছে। ফলে মুনসী উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তিটির সামাজিক মর্যাদা খানিকটা ওপরেই থাকত। যেমন মুনসী মোহাম্মদ মেহুরুল্লাহ। ১৮৬১ সালে তৎকালীন যশোর জেলার কালীগঞ্জে তাঁর জন্ম। স্থানীয় মওলানা ও মৌলভিদের কাছ থেকে তিনি কোরআন-হাদিস, আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষা এবং সাহিত্যে বিশেষ জ্ঞান লাভ করেন; কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। তাই দর্জির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন বক্তৃতা করে ও লেখনী দিয়ে। ফলে সনদপ্রাপ্ত মওলানা না হলেও ইসলামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাঁর পদবি জোটে মুনসী। তাঁর প্রায় সমসাময়িক ছিলেন সামাজিক নকশা রচয়িতা নামদার মুনসী। বর্ধমান জেলার বালিয়া পরগনায় তাঁর জন্ম। উনিশ শতকের মুসলমান লেখকদের অন্যতম তিনি। একই কথা খাটে সিলেটের কমলগঞ্জের কবি, পুঁথি ও লোকসাহিত্য সংগ্রাহক সাহিত্যরতœ মুনসী আশরাফ হোসেনের ক্ষেত্রেও। কওমি মাদরাসায় পাঁচ বছর শিক্ষা গ্রহণ করে তিনি মুনসী উপাধি লাভ করেন। এক সময় ব্যক্তিগত উপাধি হয়ে ওঠে বংশেরও খেতাব। যেমন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আবদুর রউফ। তাঁর বাবা মুনসী মেহেদি হাসান ছিলেন মসজিদের ইমাম। আবদুর রউফ মুনসী উপাধি পেয়েছেন তাঁর বাবার সূত্রে। মুনসী উপাধি শুধু মুসলমানদের উপাধি নয় হিন্দুদের মধ্যে অনেক পরিবারের উপাধি রয়েছে মুনসী। যেমন বগুড়া জেলার শেরপুর শহরে মুনসী জমিদারদের বাসস্থান ছিল। শেরপুরে হিন্দু জমিদারদের মধ্যে মুনসী জমিদাররাই ছিল প্রভাবশালী। ১৮৬৮ সালে স্থানীয় কিছু দানশীল জমিদার পরিবারের অর্থানুকুল্যে ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের উদ্দ্যোগে শেরপুর ডিজে হাইস্কুল এর প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও প্রধানত মুনসী পরিবারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এর বিকাশ ঘটে। ১৯০৪ সালে নির্মিত ই আকৃতি বিশিষ্ট বিদ্যালয়ের মুল ভবনটি মুনসী জমিদার পরিবারের অবদান। স্বর্গীয় জমিদার শ্যামা কিশোর মুনসী,স্বর্গীয় জমিদার কালি কিশোর মুনসী শেরপুর ডিজে হাইস্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এখনও মুনসী জমিদারদের বংশধর অনেকেই শেরপুর শহরে বসবাস করেন।
“নঈম উদ্দিন সিদ্দিকীর দিল্লী আগমন”
সিরাজগঞ্জের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ এস এম আব্দুস সামাদ রচিত “গৌরবান্বিত সদানন্দপুর” ইতিহাস গ্রন্থ ও কড্ডা গ্রামের প্রয়াত মুনসী মফিজুল হক সিদ্দিকীর পান্ডুলিপি থেকে জানাযায় নঈম উদ্দিন সিদ্দিকী ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বক্কর সিদ্দিকীর তেতাল্লিশতম বংশধর। ১৬৯৫ খৃ: নঈম উদ্দিন সিদ্দিকী ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে পবিত্র মদিনা থেকে বের হয়ে বিভিন্ন দেশ ও পীর আউলিয়ার মাজার জিয়ারত শেষে তুর্কীস্থানের বোখারা শরীফে হযরত পীর আহম্মদ শাহ নকসবন্দী (রা:) এর দরবারে পৌছেন। হযরত পীর আহম্মদ শাহ নকসবন্দী দর্শন প্রার্থী নঈম উদ্দিন সিদ্দিকীর পরিচয় জানতে পেয়ে তাকে নিজ গৃহে স্থান দেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের সম্পর্ক গভীর হয়ে ওঠে। সে সময় দিল্লীর সম্্রাট ছিলেন বাদশা আওরঙ্গজেব। এক সময় বাদশা আওরঙ্গজেব জানতে পারেন যে বোখারা শরীফে হযরত পীর আহম্মদ শাহ নকসবন্দী নামে একজন বিজ্ঞ কামেল ব্যক্তি আছেন। তখন হযরত পীর আহম্মদ শাহ নকসবন্দী কে দিল্লীতে নিয়ে আসার জন্য উপযুক্ত উপঢৌকন সহ বাদশা আওরঙ্গজেব একজন প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। বাদশা আওরঙ্গজেব এর আমন্ত্রনে হযরত পীর আহম্মদ শাহ নকসবন্দী দিল্লী আসার সময় নঈম উদ্দিন সিদ্দিকী কে সঙ্গে নিয়ে আসেন। কিছুদিন পর বাদশা আওরঙ্গজেব নঈম উদ্দিন সিদ্দিকীর আচার আচরনে সন্তষ্ট হয়ে বাদশা আওরঙ্গজেব এর ভাতিজী অর্থাৎ দারার কন্যা কুলছুম খাতুন কে নঈম উদ্দিন সিদ্দিকীর সাথে বিয়ে দেন। নঈম উদ্দিন সিদ্দিকীর ঔরশে এবং কুলছুম খাতুনের গর্ভে ১৭১২ খৃ: নুরউদ্দিন সিদ্দিকী জন্মলাভ করে। নুরউদ্দিন সিদ্দিকী অল্প দিনের মধ্যেই আরবী উর্দ্দু ফার্সী ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
“নবাব আলীবর্দ্দী খাঁর রাজ দরবারে নুরউদ্দিন সিদ্দিকী”
১৭৪০ খৃ: বাংলার নবাব আলীবর্দ্দী খাঁ দিল্লীর স¤্রাট মোহাম্মদ শাহকে রাজ্যের উপঢৌকন প্রদানের জন্য দিল্লী গমন করেন। সেখানেই নুরউদ্দিন সিদ্দিকীর সঙ্গে নবাব আলীবর্দ্দী খাঁর আলাপ পরিচয় হয়। নবাব আলীবর্দ্দী খাঁ নুরউদ্দিন সিদ্দিকীর বিদ্যা বুদ্ধি জ্ঞান প্রতিভা ও বংশ পরিচয় জেনে প্রীত হয়ে নুরউদ্দিন সিদ্দিকী কে মুর্শিদাবাদ সঙ্গে নিয়ে আসার জন্য স¤্রাট মোহাম্মদ শাহ এর নিকট আগ্রহ প্রকাশ করে অতিরিক্ত উপঢৌকন প্রদান করেন। স¤্রাট মোহাম্মদ শাহ নবাব অঅলীবর্দ্দী খাঁর প্রস্থাব ও অতিরিক্ত উপঢৌকন পেয়ে নুরউদ্দিন সিদ্দিকী কে মুর্শিদাবাদ পাঠাতে সম্মত হন। নবাব আলীবর্দ্দী খাঁ মুর্শিদাবাদে এসেই নুরউদ্দিন সিদ্দিকী কে প্রথমে মুনসী উপাধি দিয়ে তাঁর রাজ দরবারে সেক্রেটারী (ট্রেজারার) পদে নিযুক্ত করেন।
বাংলা রিহার উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দ্দি খাঁর তিন মেয়ে ছিল। প্রথম মেয়ের নাম ছিল মেহেরুন্নেছা অর্থাৎ ঘোষেটি বেগম,দ্বিতীয় মেয়ের নাম ছিল শাহী বেগম ও তৃতীয় মেয়ের নাম ছিল আমিনা বেগম। নবাব আলীবর্দ্দি খাঁ তার তিন মেয়েকে আপন তিন ভাতিজা অর্থাৎ আপনভাই আহম্মদ আলীর তিন ছেলের সাথে বিয়ে দেন। বড় ভাতিজা নওয়াজেস মোহাম্মদের সাথে মেহেরুন্নেছা অর্থাৎ ঘোষেটি বেগম,মেঝ ভাতিজা আলী আহম্মদের সাথে মেঝ মেয়ে শাহী বেগম এবং ছোট ভাতিজা জয়েন উদ্দিনের সাথে ছোট মেয়ে আমিনা বেগমের বিয়ে দিয়ে জামতাদের তিনটি রাজ্য পচিালনার দায়িত্ব অর্পন করেন। বড় মেয়ের জামাই নওয়াজিস মোহাম্মদ কে ঢাকার জিঞ্জিরায়, মেঝ জামাই আলী আহম্মদকে উড়িষ্যা এবং ছোট জামাই জয়েন উদ্দিন কে বিহারের দায়িত্ব দেন।
“মুনসী নুর উদ্দিন সিদ্দিকীর সিরাজগঞ্জ আগমন”
কিছুদিন পর নবাব আলীবর্দ্দি খাঁ রাজকার্য্য পরিদর্শন করার জন্য ও বড় মেয়ে ঘোষেটি বেগমকে দেখার জন্য পীর মেহেরউল্লাহ, ট্রেজারার মুনসী নুরউদ্দিন সিদ্দিকী ও দেহরক্ষী পাঠান সর্দার আব্দুর রহমান ওরফে রাঘু খাঁ কে সাথে নিয়ে মুর্শিদাবাদ হতে গঙ্গাঁ ও পদ্মা নদী হয়ে বর্জানৌকা যোগে ঢাকা রওয়ানা হন। পথিমধ্যে সিরাজগঞ্জের কালিয়ার জমিদার (কালিয়া হরিপুর) আবু মাহমুদ মির্জার অফিস পরিদর্শন করার জন্য বর্জানৌকার দিক পরিবর্তন করে কালিয়ায় যাত্রা বিরতী করেন। কালিয়ায় রাজকার্য্য পরিদর্শনকালে খাতাপত্রে কিছু গড়মিল পরিলক্ষিত হওয়ায় সেখানকার জমিদার আবু মাহমুদ মির্জার কার্য্যাবলী পক্ষুণাপক্ষুভাবে পরিদর্শন করার জন্য ট্রেজারার মুনসী নুরউদ্দিন সিদ্দিকী, পীর মেহের উল্লাহ, ও পাঠান সর্দার আব্দুর রহমান ওরফে রাঘু খাঁ কে কালিয়ায় রেখে নবাব আলীবর্দ্দি খাঁ বড় মেয়ে মেহেরুন্নেছা অর্থাৎ ঘোষেটি বেগম কে দেখতে ঢাকায় যান। নবাব আলীবর্দ্দি খাঁ ঢাকায় গেলে মুনসী নুরউদ্দিন সিদ্দিকী কালিয়ার জমিদার আবু মাহমুদ মির্জার অফিসে নিয়োজিত হয়ে কার্য্যক্রম তদারকি করতে থাকেন। কালিয়ার জমিদার আবু মাহমুদ মির্জা, মুনসী নুরউদ্দিন সিদ্দিকীর দৈহিক গঠন, বিদ্যা, বুদ্ধি,বংশ পরিচয় জেনে জমিদার আবু মাহমুদ মির্জার একমাত্র মেয়ে মোছা: নুরুননেচ্ছা খাতুনকে মুনসী নুরউদ্দিন সিদ্দিকীর সাথে বিবাহ দিয়ে জামাই মুনসী নুরউদ্দিন সিদ্দিকী কে নিজ প্রসাদে রেখে দেন। কিছুদিন পর নবাব আলীবর্দ্দি খাঁ ঢাকা হতে মুর্শিদাবাদ ফেরার পথে কালিয়ায় এসে মুনসী নুরউদ্দিন সিদ্দিকী কে সঙ্গে নিয়ে মুর্শিদাবাদ যেতে চাইলে মুনসী নুরউদ্দিন সিদ্দিকী মুর্শিদাবাদ ফিরে যেতে অসন্মতি জানান। মুনসী নুরউদ্দিন সিদ্দিকী মুর্শিদাবাদ ফিরে যেতে অসন্মতি জানাতে দেখে পীর মেহের উল্লাহ, ও পাঠান সর্দার আব্দুর রহমান ওরফে রাঘু খাঁও মুর্শিদাবাদ ফিরে যেতে অসন্মতি জানান। পরে নবাব আলীবর্দ্দি খাঁ কিছুটা অসন্তষ্ট হয়ে একাই সৈন্য সামন্ত সাথে নিয়ে বর্জানৌকা যোগে মুর্শিদাবাদ ফিরে যান। তবে যাবার কালে মুনসী নুরউদ্দিন সিদ্দিকী কে কড্ডা,পীর মেহের উল্লাহ কে রায়পুর ও পাঠান সর্দার আব্দুর রহমান ওরফে রাঘু খাঁ কে কোনাগাঁতী মৌজার ইজারাদার নিয়োগ করে যান। এদিকে জমিদার আবু মাহমুদ মির্জা বার্ধ্যকে উপনিত হলে তাঁর একমাত্র মেয়ে মোছা: নুরুননেচ্ছা খাতুন ও একমাত্র মেয়ের জামাই মুনসী নুরউদ্দিন সিদ্দিকী কে জমিদারী লিখে দেন।
প্রাচীন কালের কড্ডা গ্রাম: সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী গ্রামের নাম কড্ডা। সিরাজগঞ্জ শহর হতে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিনে বৃহত্তর কড্ডা গ্রামের অবস্থান। কতকাল আগে এই গ্রামের নামকরন কড্ডা হয়েছে তার কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারনা করা হয় নবাবী আমলের আগেও কড্ডা গ্রামের নাম প্রচলন ছিল। সে সময় এই অঞ্চল নসিরাবাদ (ময়মনসিংহ) চাকলার অধীনে ছিল। তখন সদানন্দপুর নামে কোন গ্রাম বা মৌজা ছিলনা। কড্ডা গ্রাম ৫ টি পাড়ায় বিভক্ত ছিল। যেমন কড্ডা পুর্বপাড়া, কড্ডা পশ্চিমপাড়া, কড্ডা দক্ষিনপাড়া, কড্ডা উত্তরপাড়া ও কড্ডা ভূঁইয়াপাড়া। কড্ডা পুর্বপাড়াই আজ সদানন্দপুর গ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
“ মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকীর জমিদারী লাভ”
কিংবদন্তী আছে ১৭৪৯ সালে মুনসী নুরউদ্দিন সিদ্দিকীর ওরশে ও মোছা: নুরুননেচ্ছা খাতুনের গর্ভে মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকী জন্ম লাভ করে। মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকী ছিলেন জন্মগত বাক প্রতিবন্ধী (বোবা)। ১৭৬৯ সালে মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকীর বয়স যখন ২০ বছর,তখন জমিদার মুনসী নুরউদ্দিন সিদ্দিকী, কালি চরণ মজুমদারকে নায়েব নিযুক্ত করে মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকী কে জমিদারীর উত্তরাধীকারী ঘোষনা করেন এবং কিছু দিন পরই জমিদার মুনসী নুরউদ্দিন সিদ্দিকী মৃত্যবরণ করেন। অত:পর ইংরেজী ১৭৭০ সালে,বাংলা ১১৭৬ সালে দেশে ভয়ানক দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়। যা ছিয়াত্তরের মন্বান্তর নামে পরিচিতি লাভ করে। বাংলা ১১৭৬ এর দূর্ভিক্ষের সময় শত শত লোক না খেয়ে মারা যায়। তখন কড্ডা এলাকার মানুষের ঘরে খাবার ছিলনা,পড়নে কাপড় ছিলনা। অনাহারে অর্ধাহারে থেকে প্রজাগন দূর্ভিক্ষের সময় জমিদারের খাজনা দিতে না পারায় তারা কালিয়ার জমিদার বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হয়। অল্প বয়সী তরুণ জমিদার মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকী প্রজাদের দু:খে ব্যথিত হয়ে তাদের সব খাঁজনা মাফ করে দেন এবং শত শত টাকা ও খাদ্যশষ্য প্রজাদের দান করেন।
“সদানন্দপুর গ্রামে জমিদার মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকী”
১৭৫৬ সালে নবাব আলীবর্দ্দি খাঁ তাঁর ছোট মেয়ে আমিনা বেগমের পুত্র মুনসুর-উল-মুলুক হায়বৎ জং ওরফে সিরাজ-উদ-দৌলাকে বাংলা বিহার উরিষ্যার নবাব নিযুক্ত করার পর মৃত্যু বরণ করেন। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চক্রান্ত ও মীর জাফরের বিশ্বাস ঘাতকতায় ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর পাঠনা পালিয়ে যাবার পথে ভগবান গোলায় মীর জাফরের বাহিনীর হাতে নবাব সিরাজ- উদ- দৌলা ধরা পড়েন। বিশ্বাস ঘাতক বাহিনী তাঁকে মুর্শিদাবাদ প্রাসাদে এনে জন সম্মুখে মীর জাফরের ছেলে মিরনের হুকুমে মোহাম্মদী বেগ ছুরিকাঘাত করে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মুনসুর-উল-মুলুক হায়বৎ জং ওরফে সিরাজ-উদ-দৌলাকে হত্যা করে। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর ব্রিটিশ শাসনামলে রাজকোষে টাকার বিশেষ প্রয়োজন হওয়ায় ১৭৮৩ সালে ১০ বছর মেয়াদী জমিদারী প্রথা বাতিল করে স্থায়ীভাবে জমিদারী প্রথা বন্দোবস্ত দেয়ার ঘোষনা দেন। তখন কালিয়ার জমিদার মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকী জমিদারী চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা কড়ি এবং উপঢৌকন সহ তার বিশ্বস্ত নায়েব কালী চরন মজুমদার কে নাসিরাবাদ পাঠান। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করে নায়েব কালী চরন মজুমদার নাসিরাবাদ গিয়ে কিছু অসৎ কর্মচারীর যোগসাজসে উক্ত এলাকা তার নিজ নামে পত্তনি নিয়ে আসেন এবং নিজেকে জমিদার ঘোষনা করে জমিদার মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকী কে প্রাসাদ ছেড়ে দিতে বলেন। তখন এই অন্যায় কাজের প্রতিবাদ জানিয়ে পাঠান সর্দার আব্দুর রহমান ওরফে রাঘু খাঁ প্রতিরোধ গড়ে তুললে কালী চরন মজুমদার ইউসুফ শাহী পরগোনার চাকুলী গ্রাম সহ কড্ডা, সদানন্দপুর ও বাজু শাহী মৌজার প্রায় ১২০০ একর জমি জমিদার মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকীর নামে পত্তনি ফেরৎ দিয়ে বসতী স্থাপন করার পরামর্শ দেন। অগ্যতায় জমিদার মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকী তাঁর পিতার সহকর্মী পাঠান সর্দার আব্দুর রহমান ওরফে রাঘু খাঁর হাত ধরে প্রাসাদ থেকে বের হয়ে এসে তখনকার কড্ডা গ্রামের পুর্ব দক্ষিন পাড়ায় বর্তমান সদানন্দপুর গ্রামের দক্ষিনপ্রান্তে বসতী স্থাপন করেন এবং পাঠান সর্দার আব্দুর রহমান ওরফে রাঘু খাঁ কোনাগাঁতী গ্রামে বসতী স্থাপন করেন।
“জমিদার মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকীর বসতী স্থাপন ও বংশ বিস্তার”
জমিদার মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকী কড্ডা গ্রামের পুর্ব দক্ষিন পাড়ায় বর্তমান সদানন্দপুর গ্রামের দক্ষিন প্রান্তে বসতী স্থাপন করলে পাঠান সর্দার আব্দুর রহমান ওরফে রাঘু খাঁ তাঁর কন্যা মোছা: মরিয়ম বেগম কে জমিদার মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকীর সাথে বিবাহ দেন। সেই থেকেই ধারনা করা হয় সদানন্দপুর গ্রামে প্রথম বসতী গড়ে তোলেন জমিদার মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকী। আরও ধারনা করা হয় জমিদার মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকী অত্যন্ত রুচিশীল মানুষ ছিলেন। জমিদার মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকীর ওরশে এবং মোছা: মরিয়ম বেগম এর গর্ভে জন্ম নেয় ৪ ছেলে। তারা হলেন মুনসী মুরাদ মাহমুদ সিদ্দিকী, মুনসী শুকুর মাহমুদ সিদ্দিকী, মুনসী জাফর মাহমুদ সিদ্দিকী ও মুনসী কামাল মাহমুদ সিদ্দিকী। মুনসী শুকুর মাহমুদ সিদ্দিকী’র এক ছেলে মুনসী শের মাহমুদ সিদ্দিকী। এদিকে বিশ্বাসঘাতকতা করে নায়েব কালী চরন মজুমদার জমিদারী দখল করলেও তা বেশীদিন ধরে রাখতে পারেনি। জমিদারী পেয়ে নি:সন্তান কালী চরন মজুমদার বেপরোয়া জীবনযাপন করে সম্পদ উড়াতে থাকে। এক সময় খাজনা বাঁকী পড়ায় তাঁর জমিদারী নিলামে ওঠে। শেষ জীবনে এসে অনেক দু:ক্ষ কষ্ট করে জীবন অতিবাহিত করে পরলোক গমন করেন।
জমিদার মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকীর নাতি, মুনসী শের মাহমুদ সিদ্দিকীর ২ ছেলে মুনসী অলি মাহমুদ সিদ্দিকী ও মুনসী আলী মাহমুদ সিদ্দিকী। বিশ্বাসঘাতক কালী চরন মজুমদারের জমিদারী নিলামে ওঠার পর সুঠামদেহী ২ নওজোয়ান মুনসী অলি মাহমুদ সিদ্দিকী ও মুনসী আলী মাহমুদ সিদ্দিকী ২ ঘোড়া বোঝাই দিয়ে টাকা নিয়ে নাসিরাবাদ গিয়ে দাদার জমিদারী পুনরুদ্ধার করেন। জমিদার মুনসী অলি মাহমুদ সিদ্দিকীর ৫ ছেলে । তারা হলেন জমিদার মুনসী কাদের মাহমুদ সিদ্দিকী, জমিদার মুনসী খায়ের মাহমুদ সিদ্দিকী, জমিদার মুনসী তাহের মাহমুদ সিদ্দিকী, জমিদার মুনসী ডাঃ আব্দুল গফুর সিদ্দিকী ও জমিদার মুনসী আব্বাস মাহমুদ সিদ্দিকী। জমিদার মুনসী তাহের মাহমুদ সিদ্দিকীর ২ ছেলে মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকী ও মুনসী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী। মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকীর ২ ছেলে। তারা হলেন মুনসী আব্দুল মালেক সিদ্দিকী ও মুনসী আব্দুল মান্নান সিদ্দিকী। মুনসী আব্দুল মালেক সিদ্দিকীর ৬ ছেলে। তারা হলেন মুনসী আব্দুল খালেক সিদ্দিকী (মেজবাহ), মুনসী মাহবুবর রহমান সিদ্দিকী, মুনসী মোছাদ্দেক হোসেন সিদ্দিকী, মুনসী সাইফুল বারী সিদ্দিকী/ডাবলু , মুনসী খায়রুল আলম সিদ্দিকী (চায়না মিঞা) ও মুনসী মনছুরুল হক সিদ্দিকী (নায়না মিঞা)। মুনসী সাইফুল বারী সিদ্দিকী/ ডাবলু’র একমাত্র ছেলে মুনসী নাহিদ আল মালেক সিদ্দিকী। মুনসী নাহিদ আল মালেক সিদ্দিকীর একমাত্র ছেলে মুনসী আহসানুল বারী সিদ্দিকী (সার্থক)।
অপরদিকে জমিদার মুনসী ডাঃ আব্দুল গফুর সিদ্দিকীর একমাত্র ছেলে মুনসী আব্দুল গনি সিদ্দিকী (গনি মিঞা)। মুনসী আব্দুল গনি সিদ্দিকী’র ৪ ছেলে। তারা হলেন মুনসী আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী, মুনসী আব্দুর রশিদ সিদ্দিকী, মুনসী আব্দুল মজিদ সিদ্দিকী ও মুনসী আব্দুল মান্নান সিদ্দিকী। মুনসী আব্দুল্লাহ সিদ্দিকীর ৬ ছেলে ৩ মেয়ে। তারা হলেন মুনসী আব্দুস সালাম সিদ্দিকী, মুনসী আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী, মুনসী আব্দুল হামিদ সিদ্দিকী, মুনসী আব্দুল আজিজ সিদ্দিকী/কাজেম, মুনসী শাহাদৎ হোসেন সিদ্দিকী, মুনসী শাকায়ত হোসেন সিদ্দিকী,মেয়ে লাইলী বেগম, চামেলী বেগম ও বেলী বেগম। মুনসী আব্দুর রশিদ সিদ্দিকী’র ১ ছেলে ৩ মেয়ে। তারা হলেন মুনসী আকরাম হোসেন সিদ্দিকী, মেয়ে সুলতানা সিদ্দিকা,সাইদা সিদ্দিকা ও শাহনাজ সিদ্দিকা। মুনসী আব্দুল মজিদ সিদ্দিকী’র ২ ছেলে ২ মেয়ে তারা হলেন মুনসী মাসুদ সিদ্দিকী, মুনসী সাইদ সিদ্দিকী ও মেয়ে কুমকুম সিদ্দিকা, মুনমুন সিদ্দিকা। মুনসী আব্দুল মান্নান সিদ্দিকী’র ২ ছেলে ৬ মেয়ে তারা হলেন মুনসী শহিদুল ইসলাম সিদ্দিকী, মুনসী রুহুল আমিন সিদ্দিকী ও মেয়ে ডলি সিদ্দিকা, আয়শা সিদ্দিকা, লিপি সিদ্দিকা, সুইটি সিদ্দিকা, বিউটি সিদ্দিকা, মাসুমা সিদ্দিকা। মুনসী শহিদুল ইসলাম সিদ্দিকী’র ৩ ছেলে মুনসী নাঈম সিদ্দিকী,মুনসী নাদিম সিদ্দিকী ও মুনসী নাফিজ সিদ্দিকী। মুনসী রুহুল আমিন সিদ্দিকী’র ৩ মেয়ে রিচি সিদ্দিকা,রিয়া সিদ্দিকা ও সারা সিদ্দিকা। মুনসী আব্দুল আজিজ সিদ্দিকী’র ৬ ছেলে ২ মেয়ে। তারা হলেন মুনসী নুর ইসলাম সিদ্দিকী, মুনসী নুরুজ্জামান সিদ্দিকী, মুনসী নূর হোসেন সিদ্দিকী, মুনসী নূর আলম সিদ্দিকী, মুনসী নূরনবী সিদ্দিকী ও মুনসী নূরুল হুদা সিদ্দিকী ও মেয়ে আসমা সিদ্দিকা ও আজিদা সিদ্দিকা।
জমিদার মুনসী ওমর মাহমুদ সিদ্দিকী কড্ডা গ্রামের পুর্ব দক্ষিন পাড়ায় বর্তমান সদানন্দপুর গ্রামের দক্ষিন প্রান্তে বসতী স্থাপন করলেও তাঁর বংশধরদের অনেকেই বর্তমানে সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া জেলা সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসতী স্থাপন করে বসবাস করছে। অনেকেই লেখাপড়া করে সরকারী বেসরকারী চাকুরী ও ব্যবসা বানিজ্য করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে,আবার অনেকেই পুর্ব পুরুষদের জমিদারী থাকায় বংশ পরম্পরায় সেই সমস্ত জমির মালিক হলেও লেখাপড়া না করায় অবহেলা ও অলসতার কারনে দিনের পর দিন সে সমস্ত মূল্যবান জমিজমা বিক্রি করে নিস্ব: হয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আবার কেউ কেউ মুনসী পদবী পরিবর্তন করে নামের আগে বা পরে শেখ, মিঞা, সরকার,তালুকদার ইত্যাদী লেখেন।
“আলহাজ্ব মুনসী তাহের মাহমুদ সিদ্দিকীর শেরপুরে আগমন”
কড্ডা গ্রামের বিশিষ্ট লেখক ও সাহিত্যিক প্রয়াত মুনসী মফিজুল হক সিদ্দিকীর পান্ডুলিপি ও সদানন্দপুর গ্রামের প্রবীন ব্যক্তি বর্তমানে ১০৩ বছর বয়স আমার চাচা মুনসী আব্দুল মান্নান সিদ্দিকীর নিকট থেকে জানা যায় তাঁর দাদার ভাই দাদা জমিদার আলহাজ্ব মুনসী তাহের মাহমুদ সিদ্দিকী জমিদারী কাজকর্ম পছন্দ করতেন না। তিনি অত্যান্ত ধর্মপরায়ণ মানুষ ছিলেন। তিনি যৌবনকাল থেকেই ঘরবাড়ী ছেড়ে বিভিন্ন মসজিদে মসজিদে গিয়ে ইবাদত বন্দেগী করতেন। আমার ফুফু মোছা: রেজিয়া বেগম (৮৩) তাঁর পিতা অর্থাৎ আমার দাদা মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকীর নিকট থেকে শুনেছেন আলহাজ্ব মুনসী তাহের মাহমুদ সিদ্দিকী পায়ে হেঁটে হজ্বব্রত পালন করেছেন। আলহাজ্ব মুনসী তাহের মাহমুদ সিদ্দিকী বাড়ীতে কিছু না বলেই মাঝে মধ্যেই শেরপুর শহরের উপকন্ঠে খন্দকার টোলায় অবস্থিত বিশিষ্ট অলি ও কামেল হজরত শাহ বন্দেগী (রাঃ) এর মাজার সংলগ্ন খন্দকার টোলা বড় মসজিদে (সেই মসজিদটি ভেঙ্গে এখন নতুন মসজিদ নির্মান করা হয়েছে) এসে নির্জনে বসে ইবাদত বন্দেগী করতেন। অনেক দিন পর বাড়ী ফিরতেন, আবার অজানার উদ্দ্যেশে বাড়ী ছেড়ে বেড়িয়ে পড়তেন। দিনের পর দিন তাঁর কোন খোঁজ খবর না পেয়ে আমার দাদা মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকী তাঁকে খুঁজতে বের হতেন। বেশীরভাগ সময় তাঁকে শেরপুর শহরের উপকন্ঠে জঙ্গল বেষ্টিত খন্দকার টোলায় অবস্থিত বিশিষ্ট অলি ও কামেল হজরত শাহ বন্দেগী (রাঃ) এর মাজার সংলগ্ন খন্দকার টোলা বড় মসজিদে নির্জনে বসে ইবাদত বন্দেগী করতে দেখতে পেতেন। মোছা: রেজিয়া বেগম তাঁর পিতা অর্থাৎ আমার দাদা মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকীর নিকট থেকে আরও শুনেছেন মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকী তাঁর পিতা আলহাজ্ব মুনসী তাহের মাহমুদ সিদ্দিকী কে খুঁজতে এসে মাঝে মধ্যে এমনও দেখেছেন যে জঙ্গল বেষ্টিত খন্দকার টোলা বড় মসজিদে এক পাশে আলহাজ্ব মুনসী তাহের মাহমুদ সিদ্দিকী ঘুমিয়ে আছেন আরেক পাশে বাঘ ঘুমিয়ে অছেন। আমার দাদা মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকী অনেক অনুরোধ করে তাঁকে বাড়ীতে নিয়ে গেলেও আবার তিনি ছুটে আসতেন খন্দকার টোলা বড় মসজিদে এবং তিনি বলতেন তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি শেরপুরেই থাকতে চান। আলহাজ্ব মুনসী তাহের মাহমুদ সিদ্দিকীর শেষ ইচ্ছা মোতাবেক আমার দাদা মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকী প্রায় ১৩০ বছর আগে শেরপুরে বসতী স্থাপন করেন। আমার দাদা মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকী, সিরাজগঞ্জের কালিয়া হরিপুর এলাকার জনৈক রামচন্দ্র সাহার সাথে শেরপুর উপজেলার ভাটরা গ্রামে প্রায় ২ শতাধিক বিঘা জমি বিনিময় (একচেঞ্জ) করে এসে সেখানে একটি খামারবাড়ী স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ঐ খামার বাড়ীটি ভাটরা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী “মুনসী বাড়ী” হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। আলহাজ্ব মুনসী তাহের মাহমুদ সিদ্দিকীর শেষ ইচ্ছা মোতাবেক প্রায় শতবর্ষ আগে তাঁর মৃত্যুর পর ভাটরা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুনসী বাড়ীতেই তাকে দাফন করা হয়েছে।
“মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকী”
আলহাজ্ব মুনসী তাহের মাহমুদ সিদ্দিকীর ছেলে আমার দাদাভাই মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকী ১৮৬৫ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার সদানন্দপুর(কড্ডা) গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছেন। সেখানে লেখাপড়া শেষ করে শেরপুরে এসে কর্মজীবন শুরু করেন। মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকীর ২ ছেলে ও ৪ মেয়ে। তারা হলেন ছেলে মুনসী আব্দুল মালেক সিদ্দিকী ও মুনসী আব্দুল মান্নান সিদ্দিকী এবং মেয়ে মোছা: ছাড়া খাতুন মোছা: হাজেরা খাতুন, মোছা: রেজিয়া খাতুন ও মোছা: রোকেয়া খাতুন। সুঠাম ও দীর্ঘদেহী মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকী মাদলার জমিদার হীরেন্দ্র নাথ রায়ের বিশ্বস্ত নায়েব বা তহশীদার হিসাবে চাকুরী করেছেন। তাঁর বাংলা ইংরেজী উর্দু আরবী হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর। তিনি হাতীতে চরে বিভিন্ন মহল্লায় গিয়ে খাজনা আদায় করেছেন। মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকী বলেছেন মাদলার জমিদার হীরেন্দ্র নাথ রায় তাঁর বংশ পরিচয় জেনে এবং কর্মদক্ষতা দেখে তাকে এতই বিশ্বাস করতেন যে জমিজমার পত্তনী কাগজপত্র সহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র আগে থেকেই স্বাক্ষর করে দিতেন। ছোট বেলায় তার মুখে অনেক কথাই শুনেছি। তিনি এমন কথাও বলেছেন যে তিনি ইচ্ছা করলে ২/৪ শ একর জমি তাঁর নিজ নামে পত্তনী লিখে নিতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি তিনি সততার সাথে কাজ করেছেন। আর এ জন্যই জমিদার হীরেন্দ্র নাথ রায় তাকে খুবই বিশ্বাস করতেন। হীরেন্দ্র নাথ রায় জমিদার হলেও মূলত জমিদারী পরিচালনা করতেন মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকী। মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকী প্রায় সময়ই বলতেন সততার কোন বিকল্প নাই। তিনি আমাদের কে সততার সাথে জীবন গড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন কেউ যদি অন্যায়ভাবে সম্পদের পাহাড় তৈরী করে সে পাহাড় বেশী দিন টেকসই হয়না সে পাহাড় ধ্বংস হবেই হবে। তিনি ছিলেন একজন সৎ ও ধর্মপরায়ন মানুষ। তিনি মসজিদে এবং ঈদগাহ মাঠে ইমামতি করতেন। তিনি নিজস্ব অর্থায়নে জনসেবা মুলক অনেক কাজ করেছেন। তিনি ভাটরা গ্রামে একটি পাকা মসজিদ নির্মান কাজ শুরু করেছিলেন। ইটের গাঁথুনীর কাজ শেষ হলেও ছাদ ঢালাইয়ের কাজ তিনি শেষ করে যেতে পারেন নাই। ১৯৬৯ সালে আমি যখন ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র তখন ৯৬ বছর বয়সে মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকী ইন্তেকাল করেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ঐ মসজিদের পাশেই তাঁকে দাফন করা হয়।
“মুনসী আব্দুল মালেক সিদ্দিকী”
মরহুম মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকীর বড় ছেলে মরহুম মুনসী আব্দুল মালেক সিদ্দিকী ১৯১২ সালে শেরপুরে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি সিরাজগঞ্জ ইসলামিয়া কলেজে লেখাপড়া করেছেন। তিনি একজন ন্যায়পরায়ন ব্যক্তি ও সমাজসেবক ছিলেন, তিনি অনেক সমাজ সেবা মূলক কাজ করেছেন। তিনি একজন নির্বাচিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ছিলেন। তিনি ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হিসাবে বেশ কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এলাকায় অনেক বিচার শালিশ করেছেন। বর্ষার দিনে নৌকা এবং শুষ্ক মৌশুমে গরু মহিষের গাড়ী, ঘোড়ারগাড়ী এমনকি পালকিতে করে অনেকেই তাকে বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যেতেন বিচার শালিশ করার জন্য। তিনি বিচক্ষনতার সাথে দরবার শালিশ করতেন। তিনি একজন ন্যায়পরায়ন ও বিজ্ঞ বিচারক হিসাবে এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। মুনসী আব্দুল মালেক সিদ্দিকী দীর্ঘদিন বগুড়ার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে জজের জুড়ি হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁকে অনেকেই মালেক মিঞা, মালেক প্রেসিডেন্ট, মালেক সরকার,মালেক ডাক্তার বলে ডাকতেন। তিনি একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু তাঁর কোন অহমিকা ছিলনা। ১৯৬৪ সালে যখন শেরপুর শহরেই তেমন পাকা বাসা বাড়ী ছিলনা তখন তিনি ২ টি ইটের ভাটা (গাদা ভাটা) দিয়ে ইট পুড়িয়ে শেরপুর উপজেলার ভাটরা গ্রামে খামার বাড়ীতে পাকা দালান নির্মাণ করেন। খামার বাড়ীতে প্রায় দেড়শতাধিক বিঘা জমিতে তিনি যে ফসল ফলাতেন তা অন্য করো পক্ষে সম্ভব হতোনা। তিনি আল্লাহতালার অশেষ রহমতে প্রতি মৌসুমে প্রায় দেড় দুই হাজার মন ধান উৎপাদন করতেন। তিনি সোনালী আঁশ পাট সহ বিভিন্ন ফসলের চাষ করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন। তিনি যেমন প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক ছিলেন তেমনি আবার জনহিতকর কাজে খরচও করতেন। তিনি অসহায় গরীব ও দুস্থ্য মানুষদের খুব ভাল বাসতেন। অনাথ এতিমদের ¯েœহ করতেন। তিনি প্রতি ঈদের দিন গরীব দুস্থ্য মানুষদের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরন করতেন। তাঁর বাড়ীতে প্রতিদিন অতিত মোশাফির এলেও কোনদিন তিনি না করতেন না, তিনি বৈঠকখানায় থাকতে দিতেন, সাধ্যমত খাবার দিতেন এবং তিনি নিজে তাঁদের খোঁজ খবর নিতেন। তিনি খুবই সৌখিন মানুষ ছিলেন। তিনি নিজস্ব বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করতেন। ব্রিটিশ আমলেই তার কলেরগান ছিলো। বিকাল হলেই আনেক মানুষ তার বাড়ীতে এসে জড়ো হতো কলের গানে গান শোনার জন্য। তিনি বড় সাইজের মারফি ফাইভব্যান্ড রেডিও কেনার পর বাড়ীতে বড় বড় এন্টিনা লাগানোর পরও শত শত মানুষ বাড়ীতে ভীড় জমাতো রেডিওতে দেশ বিদেশের খবর শোনার জন্য। তিনি সব সময় বাজারের সেরা সেরা জিনিষ ক্রয় করতেন। তিনি বাজারের সেরা বড় মাছ মাংস হালি হালি মোরগ মুরগী ক্রয় করতেন। তিনি জমিদারী ষ্টাইলেই চলাফেরা করতেন । তিনি কাপড় চোপড় সহ সংসারের প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই কোলকাতা থেকে ক্রয় করে আনতেন। তিনি শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলতেন। তিনি বাংলা ভাষার পাশাপাশি আরবী উর্দূ ফারসি ইংরেজি ভাষায়ও সমান পারদর্শী ছিলেন। তিনি অনেক কাজের মত ইসলামী কাজ কর্মের সাথেও জড়িত ছিলেন। তিনি নামাজ পড়তেন,কোরয়ান তেলওয়াত করতেন ,মিলাদ মাহফিল পরিচালনা করতেন, অনেক সময় মসজিদে ইমামতি করতেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক আত্মিয় স্বজন সহ আমরা তখন ভাটরা খামার বাড়ীতে অবস্থান করছিলাম। তখন আমি অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র। একদিন ভোররাতে আমার মেঝভাই মুক্তিযোদ্ধা মুনসী মাহবুবর রহমার সিদ্দিকী, ভগ্নীপতি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বারী খাঁন সহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের খামারবাড়ীতে অবস্থান করছে এমন খবর পেয়ে রাজাকার আলবদর সহ পাকসেনারা আমাদের খামারবাড়ী চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। এর আগে অনেকেই এসে খবর দেয় যে পাকসেনারা দলবল নিয়ে এদিকেই আসছে। তখন আমার বাবা আমাদের খামারবাড়ীতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ীর পাশে একটি পাটের জমির মধ্যে লুকিয়ে থাকার পরামর্শ দিয়ে বাড়ীর সদর দরজায় গিয়ে দাঁড়ান। এ সময় কমান্ডিং অফিসার সহ পাক সেনারা বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করার জন্য সদর দরজার দিকে এগিয়ে এলে তিনি পাকসেনাদের লক্ষ করে লম্বা সালাম দিয়ে বলেন মেহমান আগিয়েতো হামারা বৈঠকখানামে বঠনে হোগা,এই জলদিছে কুরছি লিয়েআও। তখন কমান্ডিং অফিসার কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়েন এবং হল্ড বলে সবাইকে থামিয়ে দেন। এ সময় কমান্ডিং অফিসার সহ পাক সেনারা বৈঠকখানায় গিয়ে বসেন এবং বাবার কাছে জানতে চান এ ধারমে মুক্তিফৌজ হ্যায়, বাবা বললেন নেহি হামারা সাইডমে তো মুক্তিফৌজ নেহি হ্যায়। তখন কমাডিং অফিসার বললেন মুক্তিফৌজ থাকতা হ্যায়তো আপকো উপর জুলুম চালিয়ে। এভাবে প্রায় ঘন্টা খানেক উর্দূতে কথাবার্তা বলার পর পাকসেনারা আমাদের খামার বাড়ী থেকে চলে যান। অনেকেই বলেন সেদিন মহান আল্লাহতালার অশেষ রহমত ও বাবার সাহসের সাথে শুদ্ধ উর্ধূ ভাষায় কথা বলার কারনে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সহ আমাদের খামারবাড়ীতে অবস্থানরত প্রায় শতাধিক লোকজন প্রানে রক্ষা পেয়েছিল (সেদিনের অনেক লম্বা ইতিহাস এখানে লিখে শেষ করা যাবেনা, মুক্তিযুদ্ধে শেরপুর গ্রন্থে লেখার চেষ্টা করবো)। মুনসী আব্দুল মালেক সিদ্দিকীর সাথে শেরপুর শহরের খন্দকার পাড়ার তোজাম্মেল হক খন্দকারের বড় মেয়ে মোছা:খাদিজা খানমের বিবাহ হয়। আমার নানা তোজাম্মেল হক খন্দকার একজন সরকারী চাকুরীজীবি ছিলেন। তিনি সার্কেল অফিসার হিসাবে দীর্ঘদিন জলপাইগুঁড়ি শিলিগুঁড়ি ও কোলকাতায় কর্মরত ছিলেন। আমার একমাত্র মামা আলহাজ্ব মোজাম্মেল হক খন্দকার। মুনসী আব্দুল মালেক সিদ্দিকীর ঔরশে এবং মোছা: খাদিজা খানমের গর্ভে ৬ ছেলে ও ৭ মেয়ে জন্মগ্রহন করে। ছেলেরা হলেন মুনসী আব্দুল খালেক সিদ্দিকী (মেজবাহ), মুনসী মাহবুবর রহমান সিদ্দিকী, মুনসী মোছাদ্দেক হোসেন সিদ্দিকী, মুনসী সাইফুল বারী সিদ্দিকী/ডাবলু,মুনসী খায়রুল আলম সিদ্দিকী (চায়না মিঞা) ও মুনসী মনছুরুল হক সিদ্দিকী (নায়না মিঞা) এবং মেয়েরা হলেন মোছা: শামছুন নাহার, মোছা: নুরুণ নাহার, মোছা: মনোয়ারা খাতুন, মোছা:নার্গিস আক্তার, মোছা: নাজনিন নাহার ও মোছা: পারভনি সুলতানা পপি। আমি যখন শেরপুর ডিগ্রী কলেজে ইন্টারমিডিয়েট প্রথমবর্ষে লেখাপড়া করি ১৯৭৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাতে মুনসী আব্দুল মালেক সিদ্দিকী ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী পরদিন তাঁর বাবার কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।
“মুনসী আব্দুল মান্নান সিদ্দিকী”
মুনসী আব্দুল কুদ্দুস সিদ্দিকীর ছোট ছেলে আমার একমাত্র চাচা আলহাজ্ব মুনসী আব্দুল মান্নান সিদ্দিকী (মান্নান মিঞা)। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে এমএসসি পাশ করে শেরপুর ডিজে হাইস্কুলে প্রায় ৯ মাস শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি সরকারী চাকুরি নিয়ে ঢাকায় যান । তিনি জাপান আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশ সরকারীভাবে সফর করেছেন। চাকুরি জীবনে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকল্প পরিচালক হিসাবে সরকারী চাকুরি থেকে অবসর গ্রহন করেছেন। তাঁর ২ ছেলে ১ মেয়ে। বড় ছেলে আলহাজ্ব মুনসী জিয়ন কুদ্দুস সিদ্দিকী ঢাকার একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি। তিনি ঢাকার একজন প্রতিষ্ঠিত গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। ছোট ছেলে আমেরিকা প্রবাসী প্রকৌশলী মুনসী জুবায়ের কুদ্দুস সিদ্দিকী। জুবায়ের আমেরিকায় রিয়ালষ্টেট ব্যবসা করেন। আলহাজ্ব মুনসী আব্দুল মান্নান সিদ্দিকীর একমাত্র মেয়ে এ্যাড: মোছা: মিতা ইয়াছমিন পেশায় একজন আইনজীবি। মেয়ের জামাই ব্যারিষ্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলাদেশ সুপ্রিমকোট ঢাকার একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবি। আলহাজ্ব মুনসী আব্দুল মান্নান সিদ্দিকী তাঁর কর্মজীবনে অনেক জনহিতকর কাজ করেছেন। তিনি তাঁর মায়ের নামে ভাটরা ইয়াছননেছা হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
“মুনসী সাইফুল বারী সিদ্দিকী”
মরহুম মুনসী আব্দুল মালেক সিদ্দিকীর ৪র্থ ছেলে আলহাজ্ব মুনসী সাইফুল বারী সিদ্দিকী/ডাবলু। তিনি ১৯৫৮ সালে মা মোছা: খাদিজা খানমের গর্ভে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি কৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়, ছোনকা দ্বিমূখী উচ্চ বিদ্যালয় ও শেরপুর ডিগ্রী কলেজে লেখাপড়া করেছেন। তিনি ভাটরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহন করেছেন। তিনি কলেজ জীবন থেকেই লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি শেরপুরের ইতিহাস, হজ্বের কাফেলা, হিলি থেকে কাশ্মির সহ বিভিন্ন গ্রন্থের লেখক। তিনি বগুড়ার সু-প্রাচীন শেরপুর শহর থেকে প্রকাশিত প্রথম ও বগুড়া জেলার একমাত্র সরকারী মিডিয়ালিষ্ট ভুক্ত বহুল প্রচারিত পাঠকপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা সাপ্তাহিক আজকের শেরপুর এর সম্পাদক ও প্রকাশক, বহুল প্রচারিত অনলাইন পত্রিকা শেরপুর নিউজ ২৪ ডট নেট এর উপদেষ্টা সম্পাদক, জাতীয় পত্রিকা দৈনিক সংবাদের প্রতিনিধি। তিনি জাতীয় দৈনিক বাংলার বাণী ও দৈনিক ভোরের কাগজের প্রতিনিধি ছিলেন, তিনি বগুড়া থেকে প্রকাশিত উত্তরাঞ্চলের প্রথম দৈনিক পত্রিকা দৈনিক বংলাদেশ এর ষ্টাফ রির্পোটার ও মফস্বল বার্তা সম্পাদক এবং বহুল প্রচারিত দৈনিক উত্তরবার্তায় সহ সম্পাদক ও মফস্বল বার্তা সম্পাদক হিসাবে প্রায় বিশ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বগুড়া প্রেসক্লাবের একজন সদস্য। তিনি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সাথে জড়িত। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ শেরপুর ইউনিভার্সাল টেকনিক্যাল বিএম স্কুল এন্ড কলেজের গভনিং বডির সভাপতি । তিনি চকসাদি কাশিয়াবালা দাখিল মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসাবে ৮ বছর সফল ভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ভাটরা ইয়াছন্নেছা হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার সহ সভাপতি, তিনি শেরপুর শিশু কল্যান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, তিনি শেরপুর কাদের সুফিয়া অটিষ্টিক এন্ড প্রতিবন্ধী স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, তিনি শাহনাজ পারভীন স্কুল অব হ্যাভেন ফর হিউম্যানেটির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি।
আলহাজ্ব মুনসী সাইফুল বারী সিদ্দিকী ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি ১৯৮৩ সাল থেকে প্রায় একযুগ শেরপুর উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি শেরপুর উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক ও বগুড়া জেলা যুবলীগের সহ সভাপতি ছিলেন। তিনি শেরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব বিষয়ক সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও দুই মেয়াদে যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বর্তমানে শেরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি। তিনি শেরপুর কেন্দ্রীয় শাহী জামে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সিনিয়র সহ সভাপতি, উপজেলা স্কাউট্স এর সহ সভাপতি, তিনি শেরপুর নাগরিক স্বার্থ সংরক্ষন কমিটির সভাপতি। তিনি শেরপুর উপজেলা শিল্পকলা একাডেমীর একজন সদস্য, তিনি শেরপুর সাহিত্য চক্রের সদস্য। তিনি বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা বগুড়া জেলা শাখার উপদেষ্টা,তিনি বগুড়া জেলা অটো টেম্পু মালিক সমিতির উপদেষ্টা, শেরপুর উপজেলা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ মালিক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা, শেরপুর উপজেলা পুলিশিং সমন্বয় কমিটির উপদেষ্টা, উপজেলা রিকসা ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা সহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও শ্রমিক সংগঠনের সাথেও জড়িত।
আলহাজ্ব মুনসী সাইফুল বারী সিদ্দিকী ১৯৭৮ সালের ৬ মার্চ সিরাজগঞ্জ সদরের গনেরগাঁতী গ্রামের ঐতিহ্যবাহী ভুঁইয়া পরিবারের মাজেম আলী ভুঁইয়ার ছোট মেয়ে মোছা: সুলতানা পারভিন নার্গিছ এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আলহাজ্ব মুনসী সাইফুল বারী সিদ্দিকীর একমাত্র ছেলে মুনসী নাহিদ আল মলেক সিদ্দিকী ও একমাত্র মেয়ে মোছা: ফারজানা পারভীন কলি। আলহাজ্ব মুনসী সাইফুল বারী সিদ্দিকীর এক মাত্র মেয়ে মোছা: ফারজানা পারভীন কলি’র সাথে ২০০০ সালে কাজিপুর উপজেলার মাইজবাড়ী গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুনসী পরিবারের সন্তান সাবেক সমবায় কর্মকর্তা মরহুম মুনসী আব্দুল জব্বার এর ছোট ছেলে মুনসী আশরাফুল আলম পুরনের বিবাহ হয়। মুনসী আশরাফুল আলম পুরন শেরপুরে একটি বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরীয়ান পদে কর্মরত রয়েছে। মোছা: ফারজানা পারভীন কলি’র একমাত্র ছেলে মুনসী ইফতেখার উল ইসলাম ইফতি বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ল্যাব:স্কুল এন্ড কলেজে নবম শ্রেনীর ছাত্র,এবং একমাত্র মেয়ে মোছা: আশরাফি ভিন্ন শেরপুর সরকারী আর্দর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবার প্রথম শ্রেনীতে ভর্তি হয়েছে।
“মুনসী নাহিদ আল মলেক সিদ্দিকী”
১৯৮০ সালে আলহাজ্ব মুনসী সাইফুল বারী সিদ্দিকীর প্রথম ও একমাত্র ছেলে মুনসী নাহিদ আল মালেক সিদ্দিকী তাঁর মা মোছা: সুলতানা পারভিন নার্গিছ এর গর্ভে জন্ম গ্রহন করে। মুনসী নাহিদ আল মালেক সিদ্দিকী শেরপুর টাউন কলোনী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ৫ম শ্রেনী, বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ল্যাব:স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি (ষ্টার), বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এইচ এস সি (ফাষ্ট ডিভিশন) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এমএ (বিএ অনার্স এমএ বাংলা ও এম এস এস গনযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ) পাশ করেছেন। মুনসী নাহিদ আল মালেক সিদ্দিকী শেরপুর টাউনক্লাব পাবলিক লাইব্রেরী মহিলা অনার্স কলেজে শিক্ষক হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি বগুড়ার সু-প্রাচীন শেরপুর শহর থেকে প্রকাশিত প্রথম ও বগুড়া জেলার একমাত্র সরকারী মিডিয়ালিষ্ট ভুক্ত বহুল প্রচারিত পাঠকপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা সাপ্তাহিক আজকের শেরপুর এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও বহুল প্রচারিত অনলাইন পত্রিকা শেরপুর নিউজ ২৪ ডট নেট (আবেদনকৃত) এর সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি জাতীয় দৈনিক ভোরের কাগজের শেরপুর উপজেলা প্রতিনিধি। তিনি অনলাইন পত্রিকা সোনালী নিউজের বগুড়া জেলা প্রতিনিধি এবং বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক বাংলা বুলেটিন পত্রিকার ষ্টাফ রির্পোটার হিসাবে কাজ করছেন। তিনি শেরপুর মডেল প্রেসক্লাব এর সাধারন সম্পাদক। ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর ধুনট উপজেলার দিঘলকান্দী গ্রামের সরকারী চাকুরিজীবি মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মোজাম্মেল হক সরকারের ছোট মেয়ে মোছা: শরিফুন নাহার মুন্নি (ধুনট ডিগ্রী কলেজ থেকে বিএ পাশ) এর সাথে মুনসী নাহিদ আল মালেক সিদ্দিকীর বিবাহ হয়। মুনসী নাহিদ আল মালেক সিদ্দিকীর দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ে মোছা: নাজমুন নাহার রোজ শেরউড স্কুল এন্ড কলেজের অষ্টম শ্রেনীর ছাত্রী। একমাত্র ছেলে মুনসী আহসানুল বারী সিদ্দিকী সার্থক বিদ্যাবিথী স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ছোট মেয়ে নাদিয়া নিশাত সৃষ্টির বয়স ১৩ মাস।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Back to top button
Close