বাংলাদেশের বিশ্বজয়
শেরপুর ডেস্ক: হার্ট কন্ডিশন তো বটেই, বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ দেখতে বসার আগে ব্লাড সুগারও যাচাই করিয়ে নেওয়া জরুরি! আরেকবার যাবতীয় উদ্বেগে জাতিকে কাঁপিয়ে রবিবার রাত ১০টা ৪ মিনিটে যুবারা ভাসিয়েছেন মহানন্দে। রকিবুল হাসান জয়সূচক স্ট্রোক খেলতেই হাজার মাইল দূরের পোচেফস্ট্রুম থেকেও ধারাভাষ্যকার ইয়ান বিশপ ঠিকই অনুমান করতে পারেন, ‘আমি নিশ্চিত, এখন ঢাকা, চিটাগং, সিলেট, খুলনার পথে পথে বিজয় মিছিল হচ্ছে। প্রথমবার বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দ তো এমনই বাঁধহীন হয়!’
ভারতের ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়টাই সম্ভবত দারুণ একটা শিক্ষা হয়ে আছে ক্রিকেটে—ফাইনালে কোনো স্কোরই আয়েশে টপকে যাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। রবিবারের ১৭৭ রানের মূল্যমান তাই প্রিয়ম গার্গদের অজানা থাকার কথা নয়। তবু মাথায় অদৃশ্য বরফ নিয়ে নামা বাংলাদেশি দুই ওপেনার পারভেজ হোসেন ও তানজিদ হাসানের হিসেবী শুরুতে ৫০ রান উঠে যাওয়ার পথেই কেমন যেন আত্মবিশ্বাসের তলানিতে ভারতীয় তরুণরা। প্রথম ট্রফি জয় থেকে বাংলাদেশ তখনো ১৩৮ রান দূরে। তবু ভারতীয় বোলার-ফিল্ডারদের শরীরী ভাষা বলছিল, তারা আরো বহু দূরে! তারই জেরে নতুন বলে কার্তিক ত্যাগী আর সুশান্ত মিশ্র একেকজন ওয়াইড করেছেন ৫টি করে। পরেরজন তো পথ হারিয়ে দুটি বিমারও ছুড়েছেন! এ যখন অবস্থা, তখন পোচেফস্ট্রুমের মাঠ সবুজের দখলে, সোশ্যাল মিডিয়াও উৎসবের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত।
তবে ওই যে ফাইনাল! অনেকটা হাল ছেড়ে দেওয়া দলকে এক ঝটকায় জাগিয়ে তোলেন রবি বিষ্ণয়। লেগস্পিন বাংলাদেশের সিনিয়ররাই খেলতে-টেলতে পারেন না। সেখানে ছোটদের তামিম, তানজিদ হাসান ভারতীয় লেগির করা দ্বিতীয় বলটিই আছড়ে ফেলেন সীমানার ওপারে। পঞ্চম বলে একই চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেই ফিরে আসেন সাজঘরে।
৫০ রানে ১ উইকেট—ফাইনালের ব্যাকগ্রাউন্ডে এ স্কোর দেখে মাতম করার কারণ নেই। সেমিফাইনালের সেঞ্চুরিয়ান মাহমুদুল হাসান জয় সদ্যই ক্রিজে এসেছেন। এরপর একে একে তৌহিদ হৃদয়, আকবর আলী, শাহাদাত হোসেন—ব্যাটিং গভীরতা নিয়ে দুশ্চিন্তার কী আছে? কিন্তু রবি বিষ্ণয়ের মনে তখন ভিন্ন পরিকল্পনা। লেগস্পিনের বিরানভূমি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ভড়কে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত দাওয়াই নিয়ে হাজির তিনি। একের পর এক গুগলি। আর তাতে উদ্ভ্রান্তের মতো একে একে ফিরে যান আরো তিনজন। আসলে চারজন। বিষ্ণয়ের গুগলি বুঝতে না পেরে মাহমুদুল হাসানকে বোল্ড হতে দেখেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন পারভেজ। টিভির পর্দায় দেখে আন্দাজ করা গেল যে পেশিতে টান পড়েছে তাঁর। তাতে ২ উইকেটে ৬২ রানকে পরোক্ষে মনে হচ্ছিল ৩ উইকেট। ঠিক ওই প্রথম আকস্মিক আত্মবিশ্বাস বাংলাদেশ ছেড়ে ভর করে ভারতের ওপর। সত্যি বলতে কি, ম্যাচের ভারসাম্যও প্রচণ্ড দোল খায় বাংলাদেশ ইনিংসের ১৩তম ওভারে। সেই থেকে মনে হচ্ছিল প্রতিটি বলেই বুঝি উইকেট নিয়ে যাবেন বিষ্ণয়! ব্যাটসম্যানকে ছাতার মতো ঘিরে ধরেন ভারতীয় ফিল্ডাররা। আর বিষ্ণয়ের প্রায় প্রতিটি বলেই আউটের আবেদন। প্রথম স্পেলে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচ এক রকম শেষই করে দিয়েছিলেন বিষ্ণয়। যেটুকু বা আশা ছিল, সেটিও উড়ে যায় শামীম ও অভিষেক দাস উইকেট বিলিয়ে দেওয়ায়।
না, উড়ে যায়নি। ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো দলকে ওড়ার শক্তি জুুগিয়েছেন একজন আকবর আলী। টুর্নামেন্টে সেভাবে ব্যাটিংয়ের সুযোগ না পাওয়া তিনি অধিনায়কত্বের দায়মোচনের দিন হিসেবে ফাইনালকেই বেছে নিয়েছিলেন যেন। বিষ্ণয়কে কেউ খেলতে পারছিলেন না। সেই তাঁরই এক ওভারে দুই বাউন্ডারি মেরে লেগস্পিন-ভীতি সরিয়েছেন প্রথমে। এরপর অভিষেক, পারভেজ আর রকিবুলকে নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে তিনি যখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনবদ্য রূপকথার শেষ টানতে যাচ্ছেন, তখনই বৃষ্টির হানা! সে সময় বাংলাদেশের স্কোর ৪১ ওভারে ৭ উইকেটে ১৬৩ রান। অবশ্য বৃষ্টি আইনে সমান ওভার ও উইকেট নিয়ে ১৪৫ রান করলেই চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। আর বৃষ্টি থামার পর লক্ষ্যটা নেমে আসে আরো নাগালের মধ্যে, ৩০ বলে ৭ রান। এর ৬ রানই এসেছে রকিবুলের ব্যাট থেকে। টুর্নামেন্টজুড়ে দুর্দান্ত বোলিং করে যাওয়া এ বাঁহাতি স্পিনারের দলের বিজয়ালেখ্যে তো এমন জ্বলজ্বল করেই থাকার কথা। যেমনটা অধিনায়ক অপরাজিত ছিলেন ম্যাচের শেষ পর্যন্ত। অপরাজিত ৪৩ একালে এমন কোনো স্কোর নয়। তবু ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণে এর প্রভাবেই ম্যাচসেরার পুরস্কারও জিতেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
ম্যাচের প্রথম ভাগে বাংলাদেশের সব কিছুই হয়েছে ‘পিকচার পারফেক্ট’। ম্যাচের আগে বোলারদের ছক এঁকে পইপই করে বলে দেওয়া হয় কোন ব্যাটসম্যানের জন্য কী করতে হবে, কোথায় ফিল্ডার রাখতে হবে। তবে সেটার বাস্তবায়ন করতে হয় স্কিল দিয়ে। সামর্থ্যটা সবারই কমবেশি থাকে। তবে নির্দিষ্ট দিনে স্কিলের সর্বোচ্চ স্ফুরণ ঘটে মানসিক স্থিতির ওপর। সহজ করে বললে পরিপক্বতার ওপর। আকবর আলীর বোলিং ইউনিট রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে সেই মানসিক স্থিতির কী দুর্দান্ত প্রদর্শনীই না করল! শরিফুল ইসলাম টুর্নামেন্টজুড়েই দুর্দান্ত বোলিং করেছেন। ফাইনালেও টেনে নিয়ে এসেছেন সেই ফর্ম। যিনি আসরব্যপী প্রতিপক্ষ বোলারদের ছিন্নভিন্ন করেছেন, সেই যশস্বী জয়সওয়াল শুরুতে বলই খুঁজে পাচ্ছিলেন না শরিফুলের! ফরোয়ার্ড ডিফেন্স করতে গিয়ে পরাস্ত হয়েছেন, চালিয়ে পালানোর পথ খুঁজতে গিয়েও একই দুরবস্থা। টুর্নামেন্টে ভারতের সেরা ব্যাটসম্যানকে বাউন্সারেও চমকে দিয়েছেন শরিফুল। বোলিংয়ে বাঁহাতি এ পেসারই বাংলাদেশের ম্যান অব দ্য ম্যাচ।
তবে বোলিং সাফল্য তো আর একজনের ওপর নির্ভর করে না, ব্যাটিংয়ের মতো জুটি গড়তে হয় এ বিভাগেও। তানজিম হাসান সাকিব, অভিষেক দাস অন্য প্রান্ত থেকে উইকেট তুলে নিয়েছেন। নিতে পেরেছেন এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ বোলিং ইউনিটের আরেকজন মহাগুরুত্বপূর্ণ সদস্যের কারণে—তিনি রকিবুল হাসান। ভারতীয়রা স্পিন ভালো খেলে—চিরায়ত এ ধারণাকে প্রথাগত বাঁহাতি স্পিন দিয়েই ভুল প্রমাণ করেছেন রকিবুল; ফাইনালে বাংলাদেশের সবচেয়ে মিতব্যয়ী বোলার। সঙ্গে টিম ম্যানেজমেন্টের একটি ‘মাস্টারস্ট্রোকে’র প্রশংসা না করলেই নয়। রকিবুলের উত্তর অজানা থাকতে পারে, তবে স্পিন তো আসলেই ভালো খেলে ভারতীয়রা। তাই আরেক বাঁহাতি স্পিনার হাসান মুরাদকে না খেলিয়ে বাড়তি পেসার হিসেবে খেলিয়েছে অভিষেককে, সবচেয়ে বেশি ৩ উইকেট নিয়ে সে সিদ্ধান্তের যথার্থতা প্রমাণও করেছেন যিনি।
বোলিং সাফল্যের উল্লেখযোগ্য অংশ নির্ভর করে ফিল্ডিংয়ের ওপর। ফাইনালে কোনো ক্যাচ পড়েনি, বরং দুটি রান আউট করে বোলারদের সাফল্যের অংশীদার হয়েছেন ফিল্ডাররা।
এমন দুয়ে দুয়ে চার মিলেছে বলেই যশস্বী জয়সওয়ালের আরেকটি চোখ-ধাঁধানো ইনিংসের পরও দু শ পার হতে পারেনি ভারত। শুরুতে শরিফুলের সামনে অস্বস্তিকর সময়টুকু আর একই বোলারের লাফিয়ে ওঠা বলে ক্যাচ দেওয়ার আগে ভারতের এ টপ অর্ডারের ব্যাটিং তাঁর সমর্থক তো বটেই, নিরপেক্ষ দর্শকদেরও আনন্দ দিয়ে থাকবে। বিশ্বকাপে সেরারাই খেলে। তবে সেই সেরাদের ভিড়েও যশস্বী আলাদা করে চিনিয়েছেন নিজেকে।
কে জানত ফাইনালের জন্য শুধু ব্যাটিংই না, নিজের সহজাত ফিল্ডিংয়ের সঙ্গে ভূমিকা রাখবেন খণ্ডকালীন লেগ স্পিন বোলিংয়েও। পারভেজ হোসেন ইমন চোট সারিয়ে ফিরেছিলেন দলকে জয়ের পথে বয়ে নিতে যেতে। যাচ্ছিলেনও। সে কারণেই কি না, অনন্যোপায় ভারত অধিনায়ক প্রিয়ম গার্গ ভাগ্য পরীক্ষার ঝুঁকি নেন যশস্বীর হাত বল তুলে দিয়ে। তাঁর দ্বিতীয় ওভারের শেষ বলটা তুলে মারতে গিয়ে আউট হন পারভেজ। ম্যাচের মোড় আরেকটি বড় বাঁক নেয় কার্যত তখনই। তবে বাংলাদেশ যুবদলের ‘সম্রাট’ আকবরের ব্যাটেই গন্তব্য পৌঁছায় যুব বিশ্বকাপ ২০২০। আর কোনো শোকগাথা নয়, আকবর এবং তাঁর সহযোদ্ধারা মিলে রচনা করেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনবদ্য রূপকথা—প্রথম বিশ্বকাপ জয়। হোক ছোটদের, তবু তো বিশ্বকাপ! সুত্র কালের কন্ঠ।